নীলু কিছু বলল না। হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম তার চোখ ভেজা।
কী হয়েছে রে?
কিছু হয় নি।
চোখে পানি। কেউ কিছু বলেছে নাকি?
জ্বি না। কে আবার কি বলবে?
হঠাৎ আমার মনে হল মগবাজারের ফুফুর যাদি নীলুকে পছন্দ হয়, তাহলে মন্দ হয় না। ফরিদ ভাই ছেলেটি ভালো। নীলু, সুখীই হবে। তাছাড়া সুখী হবার প্রধান কারণ হচ্ছে টাকা পয়সা, যা ফুফুদের প্রচুর আছে।
নীলু বললো, ফুফু, আমাকে কী জন্যে ডাকছেন জানেন?
জানি। তাঁর ছেলের জন্যে মেয়ে দেখছেন। সুন্দরী মেয়ে হলেই তিনি কথাবার্তা বলে দেখেন চলবে কিনা।
নীলু, শান্তস্বরে বলল, আমার মতো গরিব মেয়েদের আপনার ফুফু দেখবেন ঠিকই কিন্তু বিয়ে দেবার সময় বিয়ে দেবেন তাদের মতো একটা বড়োলোকের মেয়ের সঙ্গে।
আমি বেশ অবাক হলাম। কলেজে উঠে মেয়েটি কথা বলতে শিখেছে। নীলু চায়ের কেতলি হাতে নিচে নেমে গেল।
দাদার ঘরে ঢুকেই একটা হালকা অথচ তীক্ষ্ণ গন্ধ পাওয়া গেল। মৃত্যুর গন্ধ। আমার ভুল হবার কথা নয়। মা যে-রাতে মারা যান, সে-রাতে আমি মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছিলাম। তিনি তখন দিব্যি ভালো মানুষ। অসুখ সেরে গেছে। দুপুরবেলা বারান্দায় খানিকক্ষণ বসেও ছিলেন। সন্ধ্যাবেলা খবরের কাগজ পড়তে চাইলেন। খুঁজেপেতে ভেতরের দুটি পাতা পাওয়া গেল। আমি দেখলাম তিনি মন দিয়ে সিনেমার পাতা দেখছেন; যে-রোগী সিনেমার পাতা পড়ে তার রোগ সেরে গেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি বিচলিত বোধ করতে লাগলাম। কেমন যেন অন্য রকম একটা গন্ধ ঘরে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কিন্তু তীক্ষ্ণ। মা বললেন, পাবদা মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। টগর, তুই দেখিস তো পাবদা মাছ পাওয়া যায় কিনা।
আমি তার জবাব না দিয়ে বললাম, একটা গন্ধ পাচ্ছি মা?
কি রকম গন্ধ?
অন্য রকম, অচেনা।
অডিকেলন দিয়েছি। কপালে, তার গন্ধ বোধহয়।
অডিকেলনের মিষ্টি গন্ধের সাথে তার মিল আছে, কিন্তু অডিকেলন নয়। এ অন্য জিনিস। একটা অচেনা গন্ধ।
দাদাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে
দাদাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। কেমন যেন কুৎসিত। যেন কিছু একটা তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছে। কী সেটা–আত্মা? তিনি আবার আগের মতো টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছেন। চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন। তাঁর তাকাবার ভঙ্গি দেখে মনে হল কোনো কিছু চিনতে পারছেন না। যেন নিতান্ত অপরিচিত একটি জায়গায় হঠাৎ গিয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখে গভীর আতঙ্কের ছাপ। নিদারুণ একটি ভয়। কিসের জন্যে এই ভয়? কাকে ভয়?
ডাক্তার প্রদ্যোত বাবু চেয়ারের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমের ভঙ্গিটা কুৎসিত। ছোট শিশুদের মতো হা করে ঘুম। জিভটা আবার ক্ষণে ক্ষণে নড়ছে। রমিজ সাহেবকে দেখলাম না। তিনি সম্ভবত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে গিয়েছেন। বাবা নেমে এসেছেন। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের প্রতীক হিসেবে হাতে একটা পত্রিকা ধরে রেখেছেন। রোগীর কারণে নয়, বাবার উপস্থিতির জন্যেই সবাই কথা বলছে নিচু গলায়। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই বাবা বললেন, তোমার ছোট ফুফু এখনো আসছেন না কেন খোঁজ নাও। (বাবা কখনো কাউকে তুই বলেন না। এবং যে-কোনো কথা এমনভাবে বলেন, যেন মনে হয় এটিই তাঁর শেষ কথা।)
আমি বললাম, আমাদের টেলিফোন ঠিক নেই।
আমি নিচে নামার আগেই ডাঃ ওয়াদুদকে টেলিফোন করে এসেছি। টেলিফোন ঠিক নেই কথাটা ভুল। না জেনে কিছু বলবে না।
বাবা গম্ভীর মুখে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন, যেন কিছুই হয় নি। আমি পা টিপে টিপে চলে গেলাম তেতলায়। টেলিফোন বাবার শোবার ঘরে থাকে।
হ্যালো-ছোট ফুফু।
কে, টগর?
জ্বি।
বাবার অবস্থা এখন কেমন?
ভালো না। তুমি আসছ না কেন?
আমি তো সেই কখন থেকে কাপড়টাপড় পরে বসে আছি। দু বার টেলিফোন করলাম। রিং হয়, কিন্তু কেউ ধরে না।
আমরা সবাই নিচে, সেজন্যেই কেউ ধরে না। কাপড় পরে বসে আছ, আসছ না কেন?
তোমার ফুফার জন্যে অপেক্ষা করছি। সে এক জন কোরানে হাফেজকে আনতে গেছে। বাবাকে তওবা করাবে, দোয়াটোয়া পড়বে।
তওবা কী জন্যে?
মরবার আগে তওবা করতে হয় না?
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মরবার আগে যদি তওবা করতে হয়, তাহলে সেটা মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করার মতো। মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যে সেটা নিশ্চয়ই একটা ভয়াবহ ব্যাপার। জেনে ফেলা যে, আর কোনো আশা নেই। এবার যাত্রা শুরু করতে হবে সীমাহীন অন্ধকারের দিকে। যে মারা যাচ্ছে, তার কাছ থেকে শেষ আশার মিটমিটি প্রদীপটি কেড়ে নেয়া খুব অমানবিক কাজ। তাকে দেখাতে হবে যে, আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছি। মৃত্যু নামক হিংস্র পশুর সঙ্গে পশুর মতোই লড়ছি। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী। কে যেন সিঁড়ি বেয়ে আসছে।
বড়োফুফু এসে ঢুকলেন। তাঁর মুখ বিরক্তিতে কোঁচকান। গাল ঘামে চকচক করছে–একটা মাত্র ফোন, সেটা আবার তেতলায়। এই বাড়ির লোকদের বুদ্ধিসুদ্ধি আর কোনো কালেই হবে না।
কাকে ফোন করবেন?
বড়োফুপু তার জবাব না দিয়ে ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন। কেউ সম্ভবত ধরছে না। তাঁর মুখ আরো কোঁচকাতে লাগল–এত বড়ো বাড়ি, টেলিফোন দুটো রাখা উচিত।
কেউ ধরছে না ফুফু?
নাহ।
মনে হয়। ঘুমিয়ে পড়েছে, রাত একটা বাজে।
আমি বলে এসেছি জেগে বসে থাকতে। নবাবজাদা গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
ফুফু, আবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি যাবার জন্যে পা বাড়াতেই ইশারায় বললেন অপেক্ষা করতে। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। লাইন পাওয়া গেল না। ফুফুর মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বললাম, আমাকে কিছু বলবেন?