বড়োচাচার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। এ বাড়ির কারো পায়ের শব্দ আমি চিনি না, কিন্তু বড়োচাচার প্যায়ের শব্দ চিনি। তিনি কেমন যেন লাফিয়ে—লাফিয়ে চলেন বলে মনে হয়। থপথপ করে বানর হাঁটার মতো শব্দ হয়।
বড়োচাচা বারান্দার মাঝামাঝি গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, লাইট কোথায় গেল? আর বাম্বটা ফিউজ হল কখন? এই এই! টগর টগর।
বড়োচাচা আমাদের ঘরেও এক বার উঁকি দিলেন। তারপর আবার বানরের মতো থপথপ শব্দ করে তেতলায় উঠে গেলেন। নেমে এলেন প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই। বান্ধ নিয়ে এসেছেন বোধ হয়। কিছুক্ষণ পরই বারান্দায় এক শ পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলে উঠল। বড়োচাচা আবার থপথপ শব্দ করে নিচে নেমে যেতেই বাবু ভাই বান্ধটা খুলে নিয়ে এল। ব্ল্যাক টাওয়ার আমিও খানিকটা চেখে দেখলাম। জিনিসটা মন্দ নয়। কেমন যেন পচা নারকেলের পানির মতো। রাত বাজে দুটা দশ। বাবুভাই মৃদু স্বরে বলল, বুড়ে তাহলে মরেই যাচ্ছে?
তা বোধহয় যাচ্ছে।
দুঃখের ব্যাপার। বুড়োর সাথে আমার খাতির ছিল।
তোমার একার না, সবারই খাতির ছিল।
হুঁ। খুব মাই-ডিয়ার টাইপ ছিলেন।
কথাটা ঠিক নয়। দাদা মাই—ডিয়ার টাইপ নন। তিনি এক জন কঠিন প্রকৃতির মানুষ। তবে বাবুভাইয়ের সঙ্গে তাঁর খাতির ছিল। সুস্থ থাকাকালীন রোজ এক বার করে খোঁজ করতেন–বাবু আছে? বাবুভাই বিরক্ত হয়ে বলতেন, বুড়োর যন্ত্রণায় শান্তিতে থাকা মুশকিল। তা সম্রাট শাহজাহান আমার কাছে চায় কী?
দাদাকে আড়ালে আমরা সম্রাট শাহজাহন এবং শাহানাকে জাহানারা ডাকি। দাদাও প্রবল পরাক্রান্ত নৃপতির ভগ্ন ছবি হয়ে সারা দুপুর জাহানারার সঙ্গে গুজগুজ করেন। অনেক বয়স পর্যন্ত বেচে থাকাটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার।
বাবুভাই বোতলের আরো খানিকটা গলায় ঢািলল। আমি মৃদু স্বরে ডাকলাম, বাবুভাই!
হুঁ।
তোমার কি মনে হয়, মৃত্যুর পর কিছু আছে?
খুব সম্ভব আছে। থাকারই কথা।
বাবুভাই ঢকচক করে গ্লাসে আরো খানিকটা ঢালল।
বাবু ভাই, আর খেয়ে না। তুমি বেশি খাচ্ছি।
বেশি কোথায় দেখলি?
শেষে একটা কেলেঙ্কারি করবে।
কিছুই করব না।
বড়োচাচার গলার শব্দ শোনা গেল, আরে, এই বান্ধটা কোথায় গেল? ব্যাপার কি? বাবুভাই খিকখিক করে হাসতে লাগল।
কে হাসে, এই কে হাসে? বাবু, বাবু। এই টগর।
আমার মনে হল, বড়োচাচা খানিকটা ভয় পেয়েছেন। গলার স্বর কেমন কাঁপা কাঁপা।
কে হাসছিল? এই এই। কালাম! এই কালাম!
বড়োচাচা দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। তিনি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছেন।
মগবাজারের ফুফু এলেন সবার আগে। নিজের গাড়ি আনলেন না। তাঁকে গিয়ে নিয়ে আসতে হল। তাঁর গাড়ির কাবুরেটরে নাকি কি একটা প্রবলেম হয়েছে। আমাদের বাড়িতে আসতে হলেই তাঁর গাড়ির কাবুরেটরে প্রবলেম হয় কিংবা ব্রেক শু লুজ থাকে। বাবুতাইয়ের ধারণা, সমস্ত ঢাকা শহরে মগবাজারের ফুফুর চেয়ে কৃপণ এবং ধূর্ত মহিলা এখনো জন্মায় নি এবং ভবিষ্যতেও জন্মানির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গেলে তিনি চমৎকার জাপানী কফি-কাপে চা দেন। উদ্দেশ্য একটিই–কাপগুলি ছোট। চায়ের সঙ্গে কখনো কিছু থাকে না। আমরা কেউ দুপুরের দিকে তাঁর বাসায় গেলে তিনি বিরক্ত স্বরে বলেন, খবর দিয়ে আসতে পারিস না? ভাত চড়িয়ে ফেলেছে।
ভাত খাব না।
দুপুরে আবার ভাত খাবি না কি? বাস খানিকক্ষণ, আবার ভাত চড়াবে। কতক্ষণ আর লাগবে। রাইস কুকার আছে।
না ফুফু, বসতে পারব না।
শুধুমুখে যাবি? সময় হাতে নিয়ে আসতে পারিস না? সব সময় তাড়া, সব সময় তাড়া! কী এমন রাজকাৰ্য তোদের?
মগবাজারের ফুফুকে আমরা কেউ সহ্য করতে পারি না। বাবুভাই প্রায় খোলাখুলি এমন সব অপমানজনক কথাবার্তা বলে যে অন্য কেউ হলে বড়ো রকমের ঝামেলা বেধে যেত। মগবাজারের ফুফু, অসম্ভব ধূর্ত বলেই কোনো কথা গায়ে মাখেন না এবং এমন ভাব করেন যে কিছু বুঝতে পারেন নি।
গত বছর শীতের সময় তিনি হঠাৎ এসে বললেন, ফরিদের (তাঁর ছেলে) গ্রাজুয়েশন হবে সামারে, তাঁকে গ্রাজুয়েশন সেরিমনি এ্যাটেণ্ড করতে যেতে হবে। বাবুভাই গম্ভীর হয়ে বলল, বলেন কি ফুফু, ফরিদ ভাই তো দেশে তিন ধাক্কায়ও আই এ পাস করতে পারল না। ঐখানে গিয়ে একেবারে এম এ পাস করে ফেলল!
দেশে কি পড়াশোনা হয়? বিদেশে পড়াশোনার একটা এ্যাটমোসফিয়ার আছে। টিচাররা যত্ন নেয়।
এখানের ছেলেমেয়ে যেগুলি পাস করে, সেগুলি কীভাবে করে?
কি জানি কীভাবে করে? নকল ছাড়া তো আমি কিছু জানি না।
ফুফু, হাই তোলেন। কথা বন্ধ করতে চান। বাবুভাই ছোড়বার পাত্র না। সে প্যাঁচাবেই।
ফরিদ ভাই তো মন্দ দেখায় নি। এইখানে ছিল আই এ ফেল, বিলেতে গিয়ে দুই বছরে একেবারে এম এ 1
ফুফু, গম্ভীর হয়ে বললেন, ও দেশে তো আর আমাদের মতো নিয়ম না।–যে দুই বছর পড়তে হবে আই এ, দুই বছর পড়তে হবে বি এ, ওদের দেশে অন্য ব্যবস্থা।
ফরিদ ভাই দেশে আসবে?
আসবে। একটা মেয়েটেয়ে দেখ দেখি। ইউনিভার্সিটির ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে নাকি সুন্দর-সুন্দর মেয়ে আছে?
মগবাজারের ফুফুর সঙ্গে কথা শুরু হলে তা এক সময় না এক সময় সুন্দরসুন্দর মেয়েতে এসে থেমে যাবে। গত চার বছর ধরে তিনি সুন্দর মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোনোটাই তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। হয় নাকটা প্রয়োজনের তুলনায় ছোট, কিংবা ঠোঁট একটু মোটা। সব কিছুই যখন ঠিক থাকে, তখন দেখা যায় মেয়েটা বেটে। বাংলাদেশের সুন্দরী মেয়ে প্রসঙ্গে ফুফুর সার্ভে হচ্ছে–এদেশে সুন্দরী মেয়ে নেই। যে কটি আছে তারা হয় বেটে, নয় শ্বেতী রোগগ্রস্তা।
অল্প মাত্রায় নেশা
আমার মনে হচ্ছে বাবুভাইয়ের অল্প মাত্রায় নেশা হয়েছে। সে গুনগুন করে গাইছে–