আমি সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখলাম গাড়ি এসে ঢুকেছে। ডাক্তার চলে এসেছে। কোন জন এসেছে কে জানে? বড়ো রাস্তার মোড়ে এক জন ডাক্তার থাকেন, যাকে দেখেই যক্ষ্মারোগী বলে ভ্রম হয়। দাদার জন্যে তিনি হচ্ছেন ফুলটাইম ডাক্তার। তাঁর নাম প্রদ্যোত বাবু বা এই ধরনের কিছু। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি এ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি টোটকা অষুধ দেন। বাবুভাইয়ের এক বার টনসিল ফুলে বিশ্ৰী অবস্থা হল। কিছুই গিলতে পারেন না। এক শ দুই জ্বর গায়ে। প্রদ্যোত বাবু এসেই গম্ভীর মুখে বললেন বানরলাঠি গাছের ফল পিষে গলায় প্রলেপ দিতে। এটাই নাকি মহৌষধ।
বাবুভাই দারুণ রেগে গেল। চিঁ চিঁ করে বলল, শালা মালাউন কবিরাজী শুরু করেছে।
প্রদ্যোত বাবু (কিংবা পীযূষ বাবু), কিন্তু সত্যি সত্যি বানরলাঠি গাছের ফল যোগাড় করে পুলটিশ লাগিয়ে ছাড়লেন। অসুখ আরাম হল। যদিও বাবুভাইয়ের ধারণা, এম্নিতেই সারিত। শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধের মেকানিজমেই সেরেছে।
যাই হোক, প্রদ্যোত বাবুর আমাদের বাড়িতে মোটামুটি একটা সম্মানের আসন আছে। তিনি বাড়ি এলেই তাঁর জন্য দুধ-ছাড়া চা হয়, সন্দেশ আনান হয় এবং বাবা নিজে নেমে এসে কথাবার্তা। বলেন।
এই যে ডাক্তার, যাওয়ার আগে আমার প্ৰেশারটা দেখে যাবে।
বিনা কী-তে প্ৰেশার দেখা ছেড়ে দিয়েছি রহমান সাহেব। মেডিকেল এথিক্সের ব্যাপার আছে–হা-হা-হা।
আজ দেখলাম আমাদের প্রদ্যোত বাবু ছাড়াও অন্য এক জন ডাক্তার নামলেন। সেই ভদ্রলোকের চোখেমুখে সীমাহীন বিরক্তি, যার মানে তিনি এক জন বড়ো ডাক্তার। পিজির কিংবা মেডিক্যালের প্রফেসর বা এসোসিয়েট প্রফেসর। ভদ্রলোকের বিরক্তি দেখি ক্রমেই বাড়ছে। গাড়ি থেকে নেমেই হাতঘড়ি দেখলেন। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল দেখি ভদ্রলোক যে কতক্ষণ থাকেন তার মাঝে মোট কবার হাতঘড়ি দেখেন। কিন্তু এখন এসব এক্সপেরিমেন্টের ভালো সময় নয়। গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজে যেতে হবে। যে দুই ফুফু ঢাকায় আছেন তাঁদেরকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে।
সিঁড়িতে পা দেওয়ামাত্র নীলু, ডাকল, টগর ভাই। এই মেয়েটি নিঃশব্দে চলাফেরা করে। আচমকা কথা বলে চমকে দেয়।
দাদার অবস্থা কি বেশি খারাপ?
মনে হয়। রাতের মধ্যেই কাম সাফ হবার সম্ভাবনা।
টগর ভাই, আপনি সব সময় এইভাবে কথা বলেন কেন?
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি নীল হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। মেয়েটা চোখের সামনে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। বড়ো হচ্ছে এবং সুন্দর হচ্ছে; মেয়েরা লতান লাউগাছের চারার মতো। এই দেখা যাচ্ছে ছোট্ট এক রাত্তি একটা চারা, কয়েকটা দিন অন্যমনস্ক থাকার পর হঠাৎ চোখে পড়লেই দেখা যাবে নিজেকে সে ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। সতেজ বলবান একটি জীবন।
আচ্ছা, তুই এখন কি পড়িস যেন? (নীলুকে আমি তুই বলি। ওর সঙ্গে প্রায়ই আমার কথাবার্তা হয়। আমার সঙ্গে কথা বলার একটা গোপন অনুগ্রহ ওর আছে।)
সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি। বখশিবাজার কলেজে।
সেকেণ্ড ইয়ারে আবার কবে উঠলি?
নীলু, সে-কথার জবাব না দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, আমাকে তুই-তুই করে বলেন কেন?
সেদিনকার পুঁচকে মেয়ে, তোকে আবার আপনি-আপনি বলতে হবে নাকি?
আমি দোতলায় চলে গেলাম। বাবুভাইয়ের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। বারান্দায় আলো নেই। তার ঘরও অন্ধ-গর। আমি ঘরে ঢুকে সুইচ টিপলাম, আলো জ্বলল না। বাবুভাইয়ের গলা শোনা গেল, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়, টগর।
কী ব্যাপার? লাইট ফিউজ নাকি?
উঁহু, বান্ধ খুলে ফেলেছি। ঘর অন্ধকার দেখলে কেউ আর খোঁজ করবে না। মনে করবের কাজেকর্মেই আছি।
বারান্দাটারও খুলে ফেলেছি নাকি?
হুঁ। কামেলা ভালো লাগে না। রাতদুপুরে এর বাড়ি যাও, ওর বাড়ি যাও।–বাল্ব খুলে জমাট অন্ধকার করে দিলাম।
বাবুভাই সিগারেট ধরাল। লম্বা টান দিয়ে বলল, মরবার সময় হয়েছে মরবে, এত হৈ-চৈ কী জন্যে?
আমি চুপ করে রইলাম। বাবুভাই বলল, শুয়ে শুয়ে এইসব কথাই ভাবছিলাম।
কী-সব কথা?
যেমন ধর মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী, যে জানে এক দিন তাকে মরতে হবে। অন্য কোনো প্রাণী তা জানে না।
বুঝলে কী করে, অন্য প্রাণীরা জানে না? কথা বলেছ তাদের সাথে?
কথা না বলেও বোঝা যায়। অন্য কোনো প্রাণী মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেয় না। মানুষ নেয়।
আমিও সিগারেট ধরলাম। বাবুভাই বলল, বুড়োর অবস্থা কী?
ভালো না।
মৃত্যু ব্যাপারটা কুৎসিত। একসেপ্ট করা যায় না।
যাবে না কী জন্যে? কুৎসিত জিনিস কি আমরা একসেপ্ট করি না? সব সময় করি।
মৃত্যু স্বীকার করে নিই, কিন্তু একসেপ্ট করি না।
আমার ক্ষীণ সন্দেহ হল বাবুভাই এক ফাঁকে তার টাঙ্ক খুলে ঐটি বের করে দু-এক ঢোক খেয়েছে। বাবুভাইয়ের এই অভ্যেসটি নতুন। যে ভাবে তা প্রথম শুরু হয়েছিল, তাতে আমার ধারণা হয়েছিল অভ্যেসটি স্থায়ী হবে না। কিন্তু মনে হচ্ছে স্থায়ী হয়েছে। আমি মৃদু স্বরে বললাম, তুমি কিছু খেয়েছ নাকি?
হুঁ। বেশি না। আধা গ্লাসও হবে না। মৃত্যুর মতো একটি কুৎসিত ব্যাপার একসেপ্ট করতে হলে নাৰ্ভগুলিকে আংশিক অকেজো করে দিতে হয়। তুই এক ঢোক খাবি নাকি? ভালো জিনিস। ব্ল্যাক টাওয়ার। খাস জার্মান জিনিস। চমৎকার!
এখন না।
বাবুভাই বিছানা থেকে নেমে টাঙ্ক খুলল। আমি বললাম, আরো খাচ্ছ নাকি?
জাস্ট এ লিটল।
একটা কেলেঙ্কারি করবে শেষে।
তুই পাগল হয়েছিস? কেউ টের পাবে না।