তুমি চুপ কর ভাবী। তোমার কিছু জানতে হবে না। টগর, তোদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। তোদের উপর নির্ভর করে আমি অনেক বার বেইজিত হয়েছি। মেয়েটাকে আমি বাসায় পর্যন্ত যেতে বলেছি।
বলে দিলেই হয়, যেন না যায়।
হ্যাঁ বলব। একদম রাস্তার ভিখিরি, ঘরে হাঁড়ি চড়ে না।
আস্তে বলুন ফুফু। চিৎকার করছেন কেন?
চিৎকার করব না? তোদের কোনো মান-অপমান নেই বলে কি আমারো নেই? যত ছোটলোকের আড্ডা হয়েছে! সমস্ত ছোটলোকদের কোটিয়ে আমি বিদায় করব। পেয়েছে কি?
দারুণ একটা হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেল। বড়োচাচা এলেন। বাবা নেমে এলেন তিনতলা থেকে। নীলু। এসে দাঁড়াল সিঁড়ির মাথায়। রামিজ সাহেব এলেন আমাদের বসার ঘর থেকে। সন্ধুচিত ভঙ্গিতে বললেন, কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
নীলু কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, উনি এসব কথা বলছেন কেন?
আমি বললাম, তুমি দাদার ঘরের দিকে একটু যাও তো নীলু। দেখে এস কিছু লাগবে কিনা। নীলু নড়ল না। আমি লক্ষ করলাম সে থরথর করে কাঁপছে। তার মুখ রক্তশূন্য। বড়োফুফু। সমানে চেঁচাচ্ছেন, যত রাস্তার ছোটলোক দিয়ে বাড়ি ভর্তি করা হচ্ছে। এদের ঘাড় ধরে ধরে আমি বিদেয় করব। আমার ছেলের সঙ্গে একটা ভিখিরির মেয়ের বিয়ের কথা বলছে। এত বড়ো সাহস!
নীলু বলল, আপনি চুপ করুন।
বড়োফুফু চুপ করে গেলেন। সিঁড়ির মাথা থেকে তীক্ষ্ণ কষ্ঠে নীলু বলল, বাবা তুমি যাও এখান থেকে। রমিজ সাহেব কিছুই বুঝতে পারলেন না। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগলেন। এই অবস্থা স্থায়ী হল না। বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, কিসের জটলা হচ্ছে? এতেই ভিড় পাতলা হল। বড়োফুফু এবং চাচী, দাদার ঘরের দিকে এগোলেন, আমি উঠে এলাম সিঁড়ি বেয়ে। নীলুর দিকে তাকিয়ে হাসির ভঙ্গি করলাম। নীলুকে তা স্পর্শ করল না। হালকা স্বরে বললাম, শাহানা কোথায়, নীলু? নীলু। তার জবাব না দিয়ে তরতর করে নিচে নেমে গেল।
শাহানাকে পাওয়া গেল। তেতলার বারান্দায়। সেখানে একটা ইজিচেয়ারে সে আধশোওয়া হয়ে বসেছিল। আমাকে দেখেই সোজা হয়ে বসল। তার বসার ভঙ্গিটা ছিল অদ্ভুত একটা ক্লান্তির ভঙ্গি। বাবুভাই কি তাকে কিছু বলেছে? বিশেষ কোনো কথা–যার জন্যে একটি মেয়ের হৃদয় তৃষিত হয়ে থাকে?
আমি খুব নরম স্বরে বললাম, বাবুভাই কি তোমাকে কিছু বলেছে?
শাহানা জবাব না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। বারান্দার আলো কম বলেই এতক্ষণ চোখে পড়ে নি, এখন দেখলাম শাহানার গাল ভেজা। সে তার ভেজা গাল গোপন করার জন্যেই অন্য দিকে তাকিয়ে আছে? কারো গোপন কষ্টে উপস্থিত থাকতে নেই। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। শাহানা বলল, নিচে হৈ-চৈ হচ্ছিল কিসের? বড়োফুফু একটা ঝামেলা বাধিয়েছেন। নীলুকে আজেবাজে সব কথা বললেন।
শাহানা কোনো রকম আগ্রহ দেখাল না। আমি বললাম, তুমি একটু নীলুকে খুঁজে বের করবে? কথা বলবে ওর সঙ্গে?
শাহানা উত্তর দিল না।
এই সময় নিচ থেকে সাড়াশব্দ হতে লাগল। দাদা কি মারা গিয়েছেন? আমরা ছুটে নিচে এলাম। দাদার কিছু হয় নি। তিনি তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। হৈ-চৈ হচ্ছে সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ও বিচিত্র কারণে। রামিজ সাহেব অন্ধকার বাগানে একা একা ছোটাছুটি করছেন যেন অদৃশ্য কিছু তাঁকে তাড়া করছে। সবাই এসে ভিড় করেছে বারান্দায়। আমাদের ড্রাইভার টর্চলাইটের আলো তাঁর গায়ে ফেলতে চেষ্টা করছে। বড়োফুফু চাপা স্বরে বললেন, পাগল-ছাগল আর কি! দিব্যি ভালোমানুষের মতো বসেছিল। হঠাৎ ছুটে চলে গেল।
কদমগাছের কাছ থেকে তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ ভেসে এল। এ হাসি পৃথিবীর হাসি নয়। এ হাসি অচেনা কোনো ভুবনের। যারা বারান্দায় জটিল। পাকাচ্ছিল, সবাই একসঙ্গে চুপ করে গেল। বাবুভাই বাগানে নেমে গেল। এগিয়ে গেল। কদমগাছের দিকে। নীলুকে দেখা গেল না। শুধু দেখলাম বিলু তাদের দরজার পাশে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একসময় ছোট মেয়েটি বাগানে নেমে গেল। চারিদিক চুপচাপ, শুধু বাগানের শুকনো পাতায় তার হেটে যাবার মচমচ শব্দ হতে লাগল।
বাবুভাই রমিজ সাহেবের হাত ধরে তাঁকে এনে বারান্দায় বসাল। রামিজ সাহেবের চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ। সমস্ত মুখমণ্ডল ঘামে ভেজা। বাবুভাই বলল, রমিজ সাহেব, এখন কেমন লাগছে?
ভালো।
আমাকে চিনতে পারছেন?
জ্বি।
কী নাম আমার, বলুন দেখি?
রমিজ সাহেব নিঃশব্দে হাসলেন। বিলু। তার বাবার শার্ট শক্ত করে ধরে রেখেছে; ভয়ানক অবাক হয়েছে সে।
বাবার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
এ রকম করছে কেন?
ঠিক হয়ে যাবে। মাথায় পানি ঢাললেই ঠিক হয়ে যাবে!
বাবুভাই রমিজ সহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন কি একটু ভালো লাগছে?
জ্বি হ্যাঁ। লাগছে।
আমি কে বলুন?
রমিজ সাহেব। আবার হাসলেন। নীলু। এগিয়ে আসছে। রমিজ সাহেব তাকালেন নীলুর দিকে। তাঁকে দেখে মনে হল না, তিনি নীলুকে চিনতে পারছেন। নীলু ভয়-পাওয়া গলায় বলল, বাবার কী হয়েছে?
দাদা মারা গেলেন ভোর পাঁচটা দশ মিনিটে। নব্বুই বৎসর আগে দরিদ্র কৃষক পরিবাবে তাঁর জন্ম হয়েছিল। নব্বুই বছর তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের অসম্ভব বিত্তশালী করে দিয়ে নিঃশব্দে মারা গেলেন।
সকাল হচ্ছে। পুবের আকাশ অল্প অল্প ফর্সা হতে শুরু করেছে। অনেক দিন সূর্যোদয় দেখা হয় নি। আমি ছাদের আলিশায় হেলান দিয়ে সূর্যের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ছাদ থেকে দেখতে পাচ্ছি লোকজন ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। শুধু বাবুভাই রমিজ সাহেবের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে। আরো অনেক দূরে টিউবওয়েলের পাশে, পাথরের মূর্তির মতো নীলু বসে আছে একা একা। আমার খুব ইচ্ছা হল চেঁচিয়ে বলি, নীলু, ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।