বাধ্য হয়ে কোনো কোনো দিন যেতে হয় তাঁর ঘরে। তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন, কে তুই, বাবু?
জ্বি-না, আমি টগর।
তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
কখন পরীক্ষা, কী পরীক্ষা, কিছুই তিনি জানেন না। কিন্তু সমস্ত কথাবার্তা তাঁর পরীক্ষা দিয়েই শুরু হয়। আমি ঝামেলা কমাবার জন্যে বলি, ভালোই।
ডিভিসন থাকবে।
জ্বি থাকবে? অঙ্ক ভালো হয়েছে? অঙ্কটাই আসল ডিভিসন হয় অঙ্ক আর ইংরেজিতে। ইংরেজি কেমন হয়েছে?
ভালোই হয়েছে।
আমি আসিতে আসিতে টেন ছাড়িয়া দিল,–এর ইংরেজি বল দেখি? দাদার সঙ্গে কথা বলার এই যন্ত্রণা। আমি এম-এস সি করছি বোটানিতে, কিন্তু তাঁর কাছে বসলেই একটা ইংরেজি ট্রানস্লেশান করতে হবে। মাসখানেক আগে এক বার বাবুভাইকে ডেকে এনে পাটিগণিতের অঙ্ক কষতে দিলেন। সে অঙ্ক আবার পদ্যে লেখা–অর্ধেক পঙ্কে তার, তোহাই সলিলে। নবম ভাগের ভাগ শৈবালের জলে–ইত্যাদি। বাবু ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন, দাদা, আমি পাশটাশ করে ইণ্ডেন্টিংয়ের অফিস খুলেছি, এখন বসে বসে পাটিগণিত করব নাকি?
তুই আবার পাশ করলি কবে?
এম. এ. পাশ করলাম দুই বছর আগে।
বলিস কি! কোন ক্লাস পেয়েছিস?
আপনাকে নিয়ে তো মহা মুসিবত দেখি।
দাদাকে নিয়ে মুসিবত শুরু হয়েছে বেশ অনেক দিন থেকেই। বছর তিন ধরে হঠাৎ করে তার মাথায় গণ্ডগোল হতে শুরু করে। ব্যাপারটা সাময়িক। দিন দশেক থাকে। আবার সেরে যায়, আবার হয়! মস্তিষ্কবিকৃতির সময়টা বাড়িসুদ্ধ লোককে তিনি অস্থির করে রাখেন। এই সময় তিনি কিছুই খান না। ভাত মাখাবার সময় তিনি নাকি দেখতে পান একটা কালো রঙের বেড়াল থাবা দিয়ে তাঁর সঙ্গে ভাত মাখছে। কাজেই তিনি ভাত খেতে পারেন না। এক জনকে তখন প্লেট উঁচু করে রাখতে হয় (যাতে বেড়ালে ভাত ছুতে না পারে}। অন্য এক জনকে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিতে হয়। তুলে দেওয়া ভাত ও বেশিক্ষণ খেতে পারেন না। দু-এক দল মুখে ভুলেই চেঁচাতে থাকেন, বেড়াল গা বেয়ে উঠছে। গা বেয়ে উঠছে। চেঁচাতে চেঁচাতে এক সময় বমি করে ফেলেন। কী কষ্ট, কী কষ্ট!
অসুখের আগেও যে তাঁর সময় খব ভালো যাচ্ছিল তা নয়। দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকতেন বারান্দায়। ইজিচেয়ারে আধশোওয়া হয়ে সমস্ত দিন একা একা পড়ে থাকা নিশ্চয়ই কষ্টকর ব্যাপার। ঠিক এই বয়সে, এই অবস্থায় এক জন মানুষ কী ভাবে।–কে জানে? বসার ভঙ্গিটা অবশ্য অপেক্ষা করার ভঙ্গি। যেন কোনোএকটি বড়ো কিছুর জন্যে অপেক্ষা। সেটা নিশ্চয়ই মৃত্যু। বারান্দার অন্ধকার কোণায় এক কালের এক জন প্রবল প্রতাপের মানুষ আধোজ্যগ্রত অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। চিত্রটি অস্বস্তিকর।
এখন রাত এগারটা পঁচিশ। দাদার যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে এ জগতের জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান হতে বেশি দেরি নেই। তাঁর বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। জীবনের সর্বশেষ যাত্রাটি সুসহ করা হল না কেন কে জানে?
আকবরের মা প্রকাণ্ড একটা গামলাভর্তি ফুটন্ত পানি এনে হাজির করল। বড়োচাচী অবাক হয়ে বললেন, গরম পানি কি জন্যে?
আমি কি জানি? আমারে আনতে কইছে আনছি।
শাহানা, গরম পানির কথা কে বলেছে?
আমি জানি না, মামী।
কি যে এদের কাণ্ড! এই আকবরের মা, পানি নিয়ে যাও তো। কে বলেছে। তোমাকে পানির কথা?
বড়ো মিয়া কইছেন।
যাও, নিয়ে যাও।
আকবরের মা পানি নিয়ে যেতে গিয়ে ইচ্ছে করেই অর্ধেক পানি ফেলে ঘর ভাসিয়ে দিল। আমি দাদার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বারান্দার এক প্রান্তে উগ্র মূর্তিতে বড়োচাচাকে দেখা গেল। তাঁর সামনে কালাম। কালামের মুখ পাংশুবর্ণ।
আজকে তোর চামড়া খুলে ফেলব। মানুষ মারা যাচ্ছে বাড়িতে, আর তোর আজকে না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে? লাটসাহেব আর কি।
আমাকে দেখে বড়োেচাচার কাজের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। কালামের গালে প্রকান্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মেঘম্বরে বললেন, তোকে যে বললাম সবাইকে খবর দিতে, দিয়েছিস?
জ্বি-না, দিই নি। দেব।
একটা কথা কত বার বলা লাগে?
যাচ্ছি।
যাচ্ছিটা কখন? নিজের চোখে অবস্থাটা দেখছিস না?
চাচা, ডাক্তার আনতে কেউ গিয়েছে?
রমিজ সাহেব গিয়েছেন। রমিজ এলে তুই গাড়ি নিয়ে যাবি। বাবুকে সঙ্গে নিস। সেই মাতবরটা কোথায়?
উপরে আছে।
যা, ডেকে নিয়ে আয়। অন্য বাড়ির লোকজন ছোটাছুটি করছে, আর নিজেদের কারোর খোঁজ নেই। আফসোস।
অন্য বাড়ির লোক–অর্থাৎ রমিজ সাহেব। লম্বা কালো মোটাসোটা একটা মানুষ, যাদের দেখলেই মনে হয় এদের জন্ম হয়েছে অভাব অনটনে থাকবার জন্যে। তিনি আমাদের ভাড়াটে। একতলার চারটা কামরা নিয়ে আজ সাত বছর ধরে আছেন। এই সাত বছর কোনো ভাড়া বাড়ান হয় নি। কিন্তু তবু রমিজ সাহেব তাঁর নামমাত্র ভাড়াও নিয়মিত দিতে পারেন না। হাত কচলে চোখেমুখে দীন একটা ভাব ফুটিয়ে আমার বাবাকে গিয়ে বলেন, রহমান সাহেব, একটা বড়ো বিপদে পড়েছি।–আমার ছোট শালীর এক ছেলে–
রামিজ সাহেবের বাড়িভাড়া না-দেওয়ার কারণগুলি সাধারণত বিচিত্র হয়ে থাকে, এবং তা শেষ পর্যন্ত শোনার ধৈর্য কারো থাকে না; বাবাকে এক সময় বিরক্ত হয়ে বলতে হয়, থাক, থাকা; একটু রেগুলার হবার চেষ্টা করবেন, বুঝলেন?
জ্বি স্যার। আর দেরি হবে না।
রেগুলার হবার কোনো রকম চেষ্টা অবশ্যি দেখা যায় না। তিনি নিজের অংশের একটা ঘর সাবলেট দিয়ে ফেলেন গোঁফ ওয়ালা বেটে একটা ভদ্রলোককে। আমাদের অবশ্য বলেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বিপদে পড়েছে, তাই দিন দশেক থাকবে। সেই লোক মাস দুয়েক থাকার পর আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বড়োচাচা খুব রাগলেন। গলার রগ ফুলিয়ে বললেন, সব কটাকে ঘাতু ধরে বের করে দাও। ফাজলামি পেয়েছে? বেঁটে লোকটা খুব হরি-তথি শুরু করল, বললেই হয়, দেশে আইন-আদালত নাই? এভিকশন কি মুখের কথা? এতে বড়োচাচা আরো বেশি রেগে গেলেন এবং হুকুম দিলেন বাড়ির সব জিনিসপত্র বাইরে বের করে দিতে। আমাদের বাড়ির চাকর-ব্যাকররা অনেক দিন পর একটা উত্তেজনার ব্যাপার ঘটবার উপক্রম দেখে উৎসাহে সঙ্গে সঙ্গে আলনা, ট্রাঙ্ক, চেয়ার, টেবিল বাইরে এনে ফেলতে লাগল। আমি হৈ-চৈ শুনে বারান্দায় এসে দেখি রামিজ সাহেবের স্ত্রী রক্তশূন্য মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অত্যন্ত বিশ্ৰী ব্যাপার। এই সময় বাবুভাই এল কোথেকে এবং সে খুব স্বাক হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এইসব কি?