দাদার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি–সিরিয়াস ব্যাপার। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলছে হ্যাঁঙ্গার জাতীয় জিনিসে। মোটামুটি একটা হাসপাতাল। হাসপাতাল-হাসপাতাল গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। রুগীর মনে হয় অক্সিজেন দেওয়ায় কিছুটা আরাম হয়েছে। ছটফটানি নেই। নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছেন। এদিকে বড়োচাচীর ঘুম ভেঙেছে। তিনি একটি মোটামতো নার্সের সঙ্গে আলাপ করছেন। বড়োচাচীর মুখ গভীর। নার্সটির মুখ হাসি-হাসি। নার্স কখন এসেছে কে জানে। ছোটফুফুর কাণ্ড নিশ্চয়ই।
এক বার দাদার শরীর খারাপ হল। ব্লাড প্ৰেশার বা এই জাতীয় কিছু-মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। খবর পাওয়ামাত্র ছোটফুফা এক জন নার্স নিয়ে উপস্থিত। দিনরাত এখানে থাকবে। নার্সটির নাম ছিল–সুশী। খ্রিশ্চিয়ান। বয়স কম। খুব মিষ্টি চেহারা নাসটির। এমন সব সুন্দরী নার্স থাকে, আমার জন্য ছিল না। সুশী সেই জাতীয় নার্স, যাদের সঙ্গে হাসপাতালের ইন্টানী ডাক্তারদের প্রেম হয়। রুগীরা যাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল থাকে।
সুশী অল্প সময়ের মধ্যে দাদাকে সারিয়ে তুলল। দু দিনের মধ্যে দেখা গেল দাদা বারান্দায় ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন! সুশী তার পাশে অন্য একটি চেয়ারে বসে গম্ভীর মুখে ফুশফুশ করে সিগারেট টানছে। মাঝে মাঝে দাদা কীসব বলছেন, সুশী সে-সব শুনে খুব হাসছে। আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। দাদা কি ওর সঙ্গে রসিকতা করছেন? সেবার সুশীকে উপহার হিসেবে একটি রাজশাহী সিলের শাড়ি এবং কাশ্মীরী শাল দিলেন। উপহার পেয়ে তার কোনো ভাবান্তর হল না। যেন এ রকম উপহার সে সব সময়ই পেয়ে আসছে। রেগে গেলেন বড়োফুফু। খুব হৈ-চৈ করতে লাগলেন। একটা নার্সকে দু হাজার টাকার শাল? বাবার না হয় মাথা খারাপ, তাই বলে কি অন্য সবারও মাথা খারাপ, কেউ একটা কথা বলবে না? আমি ফুফুকে বললাম, আপনি যখন এসেছেন, আপনিই বলুন।
বলবই তো, এক শ বার বলব। একটা রাস্তার মেয়েকে দু হাজার টাকার শাল দেবে কেন?
রাস্তার মেয়ে হবে কেন? নার্স এক জন। ভালো নাস। দাদাকে সারিয়ে তুলেছে।
বাজে বকবক করিস না তো। এক্ষুণি যাচ্ছি আমি বাবার কাছে।
ফুফু ফুটে গেলেন দাদার ঘরে, ফিরে এলেন মুখ অন্ধকার করে। কী কথাবার্তা হল জানা গেল না।
অবশ্যি আজকের এই নার্সটির চেহারা বাজে। মুখে বসন্তের দাগ। বিরাট স্বাস্থ্য। মাংসের চাপে চোখ ছোট হয়ে গেছে। আমাকে উঁকি দিতে দেখেই নার্সটি চট করে। রুগীর কাছে গেল। অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে স্যালাইনের বোতলটি নেড়েচেড়ে দিল। এ সুশীর মতো নয়। সুশী। এখানে থাকলে দাদার শরীর হয়তো অনেকখানি সেরে যেত! আমার ধারণা চোখ মেলে এই নার্সটিকে দেখামাত্র আবার দাদার হাঁপানির টান উঠবে।
বড়োচাচী চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন আমার কাছে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, নার্সকে আনাল কে?
জানি না।
বড়োচাচী আমার সঙ্গে বের হয়ে এলেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গভীর। আমি বললাম, শুধু আপনারা দু জন? আর মানুষজন কোথায়?
জানি না কোথায়।
আমি লক্ষ করলাম বড়োচাচী কথা বলছেন খুব নিচু গলায়। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকলে তাঁর এ-রকম হয়। কথাই শুনতে পাওয়া যায় না।
শুনেছিস নাকি, তোর বড়োচাচা বাবুকে ত্যাজ্যপুত্র করেছে?
কি যে বলেন!
হ্যাঁ করেছে। আমাকে বলল।
এই সব কিছু না চাচী। মুসলিম আইনে ত্যাজ্যপুত্র হয় না।
তোকে কে বলল?
আমি জানি। হিন্দু আইনে হয়, মুসলিম আইনে হয় না। আর খামাকা ত্যাজ্যপুত্র করবে। কেন?
মদ খেয়ে মাতলামি করছিল, এই জন্যে করেছে।
না চাচী, এই সব কিছু না।
বড়োচাচীর মুখ সঙ্গে সঙ্গে আলো হয়ে উঠল। ইনি যে-কোনো কথা বিশ্বাস করেন। তাঁকে কেউ যদি এসে বলে–দেখে এলাম বুড়িগঙ্গায় একটা মৎস কন্যা ধরা পড়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, সত্যি? কথা বলতে পারে? চুল কত বড়ো? মানুষের বুদ্ধি যে ঠিক কতটা কম হতে পারে তা চাচীকে না দেখলে বোঝা যাবে না।
বুঝলি টগর, আমি তো শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। ভদ্রলোকের ছেলে, মদ খাবে কি?
আমি বললাম, কেউ যদি খায়ও সেটা কোনো সিরিয়াস ব্যাপার না। ওষুধের সঙ্গে তো সবাই খাচ্ছে।
তাই নাকি?
হুঁ। হোমিওপ্যাথি অযুদ্ধর সবটাই তো মদ।
তুই জানালি কোথেকে?
এটা নতুন কথা নাকি? সবাই জানে।
আগে আমাকে বলিস নি কেন?
আগে বললে আপনি কি করতেন?
তাও ঠিক, কি করতাম।
বড়োচাচী নিশ্চিত ভঙ্গিতে হাসলেন–তাঁর বুক থেকে পাষাণ-ভার নেমে গেছে। আমাকে বললেন, তোর চাচা এমনভাবে বলল কথাটা যে আমি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।
সব কথা এরকম চট করে বিশ্বাস করবেন না চাচী।
না, এখন থেকে আর করব না।
এই সময় বড়োফুফুকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে নিচে নামতে দেখা গেল। আমাদের দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। যেন আমাদেরকেই খুঁজছিলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, নীলু নামের ঐ মেয়েটির ঘরে নাকি আজ রান্না হয় নি?
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এরকম চোঁচোনর কি মানে? বড়োচাচী কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালেন।
কার ঘরে রান্না হয় নি?
ঐ যে তোমাদের ভাড়াটে। নীলু নাম যে মেয়েটির।
আমি বললাম, যা বলার আস্তে বলুন ফুফু।
আস্তে বলব কেন?
ওরা শুনবে!
শুনলে শুনবে। তোর আঙ্কেল দেখে আমি অবাক হয়েছি। এই রকম একটা ভিখিরি শ্রেণীর মেয়ে, আর তুই ওর সঙ্গে দিব্যি বিয়ের কথাবার্তা চালালি?
বড়োচাচী স্তম্ভিত হয়ে বললেন, কার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে? কই, আমি তো কিছু জানি না।