আমাদের বংশ দীর্ঘজীবী বংশ। দাদার ডিমা-বেচা বাবা মারা গিয়েছিলেন প্ৰায় এক শ বছর বয়সে। শেষ সময়ে চোখে দেখতেন না, কানে শুনতেন না, চলচ্ছক্তি ছিল না। দিনরাত নিজের মলমূত্রের মধ্যে বসে থেকে পশুর মতো গো-গোঁ করতেন। সবই শোনা কথা। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি। দাদার এই অতিবৃদ্ধ বাবাকে দেখবার কেউ ছিল না। তিনি গ্রামের বাড়িতে পড়ে থাকতেন। সেখানে তখনো সেই প্রকাণ্ড দালান (যা পরে নীলমহল নামে খ্যাত হয়) তৈরী হয় নি। দাদা সবে টাকা পয়সার মুখ দেখতে শুরু করেছেন। বন্যার মতো সম্পদ আসা শুরু হয় নি।
মানুষের মল এবং মূত্রের মধ্যে জীবনদায়িনী কিছু হয়তো আছে। দাদার বাবা মলমূত্র মেখে প্রায়-অমর হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু বাৰ্ধক্যজনিত কারণে হয় নি। হয়েছিল। ইদুরের কামড়ে। শোনা যায় ইঁদুর কামড়ে তাঁর নাভির কাছ থেকে মাংস তুলে নিয়েছিল। সেই কামড় বিষিয়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ছেলের সীমাহীন ক্ষমতার কিছুই তিনি চোখে দেখে যেতে পারেন নি।
তাঁর মৃত্যুর দু বছরের মধ্যেই নীলমহল তৈরির কাজ শুরু হয়। সে নাকি এক রাজকীয় ব্যাপার! গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল, ডিমা-বেচা খবির মিয়ার ছেলে সোনার মাইট পেয়েছে। রাজা-বাদশাদের সঞ্চিত গোপন স্বর্ণমুদ্রা পূৰ্ণ সাতটা ঘড়া। সবাই বলত–এই সব পাপের অর্থ কি আর ভোগে লাগবে? লাগবে না। তাদের কথা আংশিক ফলে গেল। দাদা বা তাঁর বংশধররা কেউ সেই প্রকাণ্ড বাড়িতে থাকল না। দাদার দশা হল বাবুই পাখির মতো। বাবুই পাখি বহু কষ্টে বহু মমতায় চমৎকার একটি বাসা বানায়, সে নিজে বাসাটিতে বাস করতে পারে না। রোদ বৃষ্টি বাদলে বসে থাকে বাইরে, বাসায় নয়। তার চোখের সামনে ভালোবাসায় তৈরি বাসাটি হাওয়ায় দোল খায়।
দাদারও তাই হল। নীলমহলে তিনি গিয়ে উঠতে পারলেন না। কারণটি বিচিত্র। রাতদুপুরে সে-বাড়ির ছাদে অশরীরী শব্দটব্দ হতে লাগল। কোথায়ও হাওয়া নেই, নীলমহলের জানালা আপনাআপনি খুলে যাচ্ছে। রাতের বেলা খড়ম পায়ে বারান্দার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত কে যেন হাঁটে। নীলমহলের ছাদে নাকি আগুনের কুণ্ড হঠাৎ-হঠাৎ ঝলসে ওঠে। আজগুবি সব ব্যাপার। নিশ্চয়ই এ সবের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, কিংবা সবটাই মনগড়া। কিন্তু মানুষমাত্রই কিছু-না–কিছুতে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। দাদা নীলমহল ছেড়ে তাঁর ছেলেদের সঙ্গে এলেন বাস করতে।
সেই চমৎকার বাড়িটির জন্যে তাঁর কি মন কদে? তাঁর ভালোবাসার নীলমহল। মৃত্যুর আগে আগে সমস্ত অতীত নাকি ছবির মতো ভেসে ওঠে। নীলমহলের অতীত কি ভাসছে তাঁর সামনে? আজ কি তাঁর মনে হচ্ছে, সমস্তই অর্থহীন? নীলমহল-লালমহল কোনো মহলাই কাজে আসে না। আজ তাঁর যাত্রা অজানা এক মহলের দিকে, যার রঙ তাঁর জানা নেই।
ছোটফুফা কাগজ-কলম নিয়ে বসেছেন। দাদার কিছু একটা হয়ে গেলে গণ্যমান্য যাদেরকে খবর দেওয়া হবে তাদের নাম-ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বার লেখা হচ্ছে। দেখতে-দেখতে তিনি ফুলস্কেপ কাগজ তিন-চারটা ভরিয়ে ফেললেন। বাবুভাইকে বললেন, দেখ তো, কেউ বাকি আছে কিনা?
বাবুভাই না তাকিয়েই বললেন, না, সবাই আছে।
না দেখেই কী করে বললি?
দেখতে হবে না। যা লিখেছেন ঠিকই লিখেছেন। সবাই আছে।
কেউ বাদ গেলে কেলেঙ্কারি হবে।
কেলেঙ্কারি হবে কেন?
ফুফা বহু কষ্টে রাগ সামলালেন। বরফশীতল স্বরে বললেন, সামাজিকতার একটা ব্যাপার আছে।
মানুষ মারা যাচ্ছে, এর মধ্যে আবার সামাজিকতা কী?
মানুষের মৃত্যুর মধ্যে সামাজিকতা নেই?
না। এটার মধ্যে এসব কিছু নেই।
বাবু ভাই হাই তুললেন। তিনি ফুফাকে রাগাতে চাইছেন। ফুফা গম্ভীর স্বরে বললেন, এটা একটা খান্দনী ফ্যামিলি। জলে-ভাসা ফ্যামিলি না। খান্দানী ফ্যামিলিতে অনেক রকম সামাজিকতা আছে।
খান্দানী! আমরা খান্দানী হলাম কবে? আমি যতদূর জানি, আমাদের পূর্বপুরুষ চাষা ছিলেন। কেউ কেউ হাটে গিয়ে ডিম বেচতেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এক জন সিঁধেল চোর ছিল। কানুচোরা নাম।
এ রকম কোনো কিছু তো জানি না।
আমি জানি।
ছোটফুফা মুখ অন্ধকার করে ফেললেন। বাবুভাই বললেন, একটা লোক মারা যাচ্ছে, তাকে মরতে দিন।
কিসের সঙ্গে কী বলছ? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।
মাথা ঠিকই আছে। ঠিক আছে বলেই বলছি, আমরা খান্দানীফান্দানী না।
ছোটফুফা গম্ভীর হয়ে বললেন, তৰ্ক করা তোমার একটা বদ অভ্যাস। এটা ছাড়া উচিত।
বাবুভাই ঘাড় মোটা করে বললেন, আমাদের খান্দানী কি জন্যে বলছেন সেটা আগে বলুন।
তোমরা খান্দানী না?
না।
বেশ তো ভালো কথা। তোমার ইচ্ছাটা কি? কাউকে কোনো খবর দেওয়া হবে না?
খবর দেওয়ার কোনো দরকার নেই।
তুমি ঠিক সোবার অবস্থায় নেই! তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না!
কথা বলতে না-চাইলে বলবেন না।
ছোটফুফা মুখ কালো করে উঠে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়ালাম। মাথা ব্যথা করছে। আমার টেবিলের ড্রয়ারে এনসিন আছে। কিন্তু বাবুভাই ঘর বন্ধ করে বসে আছেন। দরজায় ধাক্কা। তেই তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন, কে?
আমি।
যা এখন।
ঘুমোচ্ছ নাকি?
না, ঘুমাচ্ছি-টুমাচ্ছি না। তুই যা, বিরক্ত করিস না।
দরজাটা একটু খোল।
বাবুভাই জবাব দিলেন না।
কী সুন্দর লাগছে নীলুকে
রান্নাঘরে আকবরের মাকে দেখা গেল কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এদিকে গ্যাসের চুলায় একটা মাঝারি আকারের ডেকচিতে পানি ফুটছে। নিৰ্ঘাত আকবরের মার কাণ্ড। পানি ফোটাতে দিয়ে ঘুমুতে শুরু করেছে। কাউকে ঘুমুতে দেখলেই ঘুম পায়। আমি হাই তুললাম। তারপর এক সময় আবার নেমে এলাম নিচে। নিচের বারান্দা জনশূন্য। মৌলানা সাহেব পর্যন্ত নেই। মনে হচ্ছে বসার ঘরে তাঁর ঘুমাবার ব্যবস্থা হয়েছে। মৃত্যুর অপেক্ষা করতে গিয়ে সখাই বোধ করি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।