তাহলে কি?
ওকে ডেকে এমন একটা কথা বল, যা শোনার জন্যে মেয়েদের মন ভূষিত থাকে।
তৃষিত হয়ে থাকে?
হুঁ, বাংলাটা অবশ্যি একটু কঠিন বলে ফেললাম।
শাহানা হাসল। আমি নিচে এলাম। বাবু ভাই সিঁড়ির কাছে উগ্র মূর্তিতে দাঁড়িয়ে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট হাতে সে কখনো প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে না।
ব্যাপার কি বাবুভাই?
কিছু না।
ছোটফুফা কোথায়?
জানি না।
তার সঙ্গে সিরিয়াস একটা ফাইট দিলে মনে হয়।
বাবুভাই জবাব দিল না। আমি বললাম, চল, দাদার অবস্থাটা দেখে আসি।
দেখার কী আছে?
দেখার কিছু নেই?
বাবুভাই উত্তর না দিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। সে মনে হচ্ছে অত্যন্ত বিরক্ত। তার বিরক্তির আসল কারণ ষ্ট্রের পাওয়া গেল কিছুক্ষণ পর, যখন দেখলাম বড়োচাচাকে। বড়োচাচার চেহারা ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো। দিশাহারা চাউনি। ঠিক মতো কথাও বলতে পারছেন না, জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি আমার হাত ধরে একটা অন্ধকার কোণার দিকে নিয়ে গেলেন। কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, টগর, বাবু নাকি উপরে বসে মদ খাচ্ছে?
বলেছে কে আপনাকে?
তোর ছোটফুফা বললেন। মদ খেয়ে নাকি মাতলামি করছে?
বড়োচাচা সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললেন। আমি নিজেকে সামলে সহজভাবে বললাম, ছোটফুফা কি সবাইকে এই সব বলে বেড়াচ্ছে?
তুই আগে বল, এটা সত্যি কি না।
সত্যি না, চাচা।
তুই আমার গা ছুঁয়ে বল।
গা ছুঁয়ে বলার কী আছে, যত সব মেয়েলী ব্যাপার!
হোক মেয়েলী ব্যাপার, তুই আমার হাত ধরে বল।
আমি বড়োচাচার হাত ধরে শান্ত স্বরে বললাম, বিশ্বাস করুন চাচা, কথাটা ঠিক না। মিথ্যা বলব কেন?
বড়োচাচা চোখ লাল করে বললেন, তুই নিজে মিথ্যা বলছিস।
কি যে বলেন। মিথ্যা বলব কেন?
বড়োচাচা গম্ভীর স্বরে বললেন, বাবা ওকে যতটা ভালবাসেন, কাউকে তার সিকি ভাগও বাসেন না। সে কিনা এ-রকম একটা সময়ে মদ খাচ্ছে? হারামজাদা কোথাকার!
কথাটা সত্যি না।
টগর, তুই বাবুকে গিয়ে বল, সে যেন এই মুহুর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
কি যে আপনি বলেন চাচা।
যা তুই, এক্ষুণি গিয়ে বল।
এক্ষুণি বলতে হবে কেন? ঝামেলার মধ্যে নতুন ঝামেলা।
সে যদি বাড়ি ছেড়ে না যায়, আমি যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বলছি।
বলবি, সে যেন এককাপড়ে বাড়ি ছেড়ে যায়।
ঠিক আছে।
এবং কোনোদিন যেন এ বাড়িতে তার ছায়া না-দেখি।
মদ খাওয়ার ব্যাপারটা
মদ খাওয়ার ব্যাপারটা দেখলাম বেশ একটা আলোড়ন তৈরি করেছে। মোটামুটি সবাই জানে। চাচা বিদেয় হবার সঙ্গে সঙ্গে বড়োফুফুর সঙ্গে দেখা। তিনি তাঁর ভারি শরীর নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কোথাও যাচ্ছিলেন, আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, বাবু নাকি মাতলামি করছে?
মাতলামি করবে কেন?
বেহেড মদ খেয়েছে, তাই মাতলামি করছে।
বলেছে কে আপনাকে?
তুই এত জেরা করার বদভ্যাস কোত্থেকে পেলি?
আমি চুপ করে গেলাম। বড়োফুফু, আত্মকে ওঠার ভান করে বললেন, বংশের সম্মানটার কথা কেউ ভাবল না, আশ্চর্য! এত বড়ো পীরবংশ। এত নাম-ডাক। দারুণ একটা মিথ্য কথা এটা। ইদানীং লক্ষ করছি বড়োফুফু বংশ-মর্যাদা বাড়াবার চেষ্টায় নেমেছেন। অপরিচিত লোকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলতে শুরু করেছেন।–পীরবংশ। খুব খানদানি ফ্যামিলি।
আমাদের গোষ্ঠীতে পীর-ফকির কেউ নেই। দাদার বাবা ছিলেন চাষা। জমিজমা তেমন ছিল না। কাজেই শেষের দিকে পানের ব্যবসা শুরু করেন। সেতাবগঞ্জ থেকে পানের বাকা মাথায় করে এনে নীলগঞ্জ বাজারে বিক্রি করতেন। এতে তেমন কিছু ভালোমন্দ না হওয়ায় ডিমের কারবার করতে চেষ্টা করেন। চাষা সমাজ থেকে নির্বাসিত হন ডিম বেচার কারণে। তাঁর দুটি মেয়ের বিয়ে আটকে যায়। ডিম বেচা ব্যাপারীর সঙ্গে সম্বন্ধ করা যায় না। খুবই দুদিন গেছে বেচারার।
এই সব তথ্য দাদার কাছ থেকে পাওয়া। হতদরিদ্র মানুষ যখন দারুণ বড়লোক হয়ে যায়, তখন তার অভাবের গল্প করতে ভালোবাসে। দাদা যখন সুস্থ থাকেন এবং কথা বলার মতো কাউকে পান, তখন শুরু করেন। পুরনো দিনের গল্প। কবে পরপর দু দিন পেয়ারা খেয়ে ছিলেন। কবে বেতন না-দেওয়ার জন্যে স্কুল থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হল এবং তাঁর বাবা গিয়ে হেডমাস্টার সাহেবের পা ধরে বসেছিলেন একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। হেডমাস্টার সাহেব উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেছিলেন, ম্যাটিক পাশ করে হবেটা কি? ছেলেকে কাজে লাগান, সংসারে সাহায্য হোক। দাদার ম্যাট্রিক পাশ করা হল না। তিনিও ডিমের ব্যবসা শুরু করলেন। তুতার চল্লিশ বছর পর নীলগঞ্জে একটি হাইস্কুল এবং একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ দিলেন। দুটিই অবৈতনিক। স্কুলের সমস্ত ব্যয়ভার তিনিই বহন করতেন। এখনো করেন।
অভাব এবং অহংকারের গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে না। শুধু আমার একার নয়, কারোই ভালো লাগে না। কাজেই বেশির ভাগ গল্প শুনতে হয় শাহানাকে। এবং সে মেয়েলি ভঙ্গিতে আহা-উঁহু করে, বলেন কি নানাভাই, এ রকম অবস্থা ছিল? কী সর্বনাশ! থাক থাক আর বলবেন না, কষ্ট লাগে। দাদা তাতে উৎসাহ পেয়ে আরো সব ভয়াবহ কষ্টের বর্ণনা শুরু করেন। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার।
পৃথিবীতে বৃদ্ধদের মতো বিরক্তির আর কিছুই নেই। বৃদ্ধরা অসুন্দর বুদ্ধিহীন নারীদের চেয়েও বিরক্তিকর। বাবুভাইয়ের মতে পঞ্চাশের পর এদের সবাইকে কোনো একটি দ্বীপে চালান করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাষ্ট্ৰীয় পর্যায়ে করা উচিত। যেখানে সব বুড়ো-বুড়ি মিলে এক সঙ্গে বকবক করবে। ছ মাসে এক বার জাহাজ গিয়ে তাদের খাবার দাবার দিয়ে আসবে।