অবশ্যি এসব কিছুই তাদের মনে থাকবে না। দু জনেই হৈ-চৈ করবে। দু জনেই বলবে ইচ্ছে করে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। কেইস-টেইস হওয়াও বিচিত্র নয়।
আমি উসখুস করতে লাগলাম। চট করে উঠে যাওয়া যাচ্ছে না। আবার বসেও থাকা যাচ্ছে না। এসব শুনতে ভালো লাগছে না।
আপনি কি চা-টা কিছু খাবেন?
নাহ।
ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। শীত-শীত লাগছে। আমি বললাম, নিচে যাই, দেখি কী হচ্ছে।
বস একটু! আমি বসে রইলাম। বসেই রইলাম। বাবা ক্লান্ত স্বরে বললেন, কয়েক দিন আগে তোমার মাকে স্বপ্ন দেখলাম। খুব কান্নাকাটি করছিল। তুমি তাকে স্বপ্নে দেখ।
জি-না।
স্বপ্নটা কেন যে দেখলাম! স্বপ্রের কোনো মানে থাকে কিনা কে জানে?
স্বপ্নেপুর কোনো অর্থ নেই। স্বপ্ন স্বপ্নই।
বোধ হয় তাই। আজকাল আমি তোমার মায়ের কথা প্রায়ই ভাবি।
আমি চুপ করে রইলাম। একবার ভাবলাম বলি।–ভাবেন নাকি? বললাম না। অনেক কিছু, যা বাবাকে বলতে ইচ্ছে করে, তা শেষ পর্যন্ত বলা হয় না। বাবাও বোধ করি অনেক কিছু বলতে চান, শেষ পর্যন্ত কিন্তু বলেন না।
তোমার দাদা তোমার মাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন।
জানি।
সাবটা জান না! তোমার যখন জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে, তখন তোমার দাদা অন্য মানুষ!
ও।
তোমার মার বিয়ে হয় তের বছর বয়সে। আমার সঙ্গে নানা কারণে তাঁর সঙ্গে সদ্ভাব ছিল না। সে ছিল ঘরোয়া ধরনের মেয়ে। মেয়েলিপনা ছাড়া তার মধ্যে কিছু ছিল না।
বাবা কথা বন্ধ করে খুক খুক করে খানিকক্ষণ কাশলেন।
তোমার মাকে আমি পছন্দ করি নি। সে রাত-দিন কাঁদত। তোমার দাদা তাকে আদর দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিলেন। সে যে কী অসম্ভব আদর, চোখে না। দেখলে বোঝা যাবে না। তোমার মা এক বার কমলা খেতে চেয়েছিল। বাবা এক গরুর গাড়ি বোঝাই করে কমলা এনেছিলেন। সেই থেকে তোমার মার নাম হয় গেল কমলা বৌ।
বাবার গলা কি কিঞ্চিৎ ভারি হয়েছে? খুব সম্ভব না। বাবা ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না।
তোমার মাকে আমি ভালবাসতে শুরু করেছি, তার মৃত্যুর পর। এটা খুব কষ্টের ব্যাপার।
আমি উসখুস করতে লাগলাম। আমার চলে যেতে ইচ্ছে করছে। বাবার সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকার অভ্যেস আমার নেই। আমাদের কারোরই নেই। আবার উঠে যাবার সাহসও হয় না। বিশ্ৰী অবস্থা।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয় নতুন করে জীবন শুরু করার একটা সুযোগ থাকা উচিত। এমন একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে সবাই একটা করে সুযোগ পাবে।
তাহলেও দেখবেন সবাই আবার ভুল করবে।
আমি করব না।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। কেউ হয়তো আসছে, এত রাতে ছাদে আসবে কে? শাহানা নাকি? শাহানা মাঝে-মাঝে অসময়ে ছাদে এসে তার ফুলগাছের সঙ্গে কথা বলে। এই মেয়েটির মনে ভয়টয় কিছু নেই।
শাহানা এসে ঢুকল চায়ের পেয়ালা নিয়ে।
মামা, আপনার জন্যে একটু কফি এনেছি।
বুঝলি কী করে, আমি এখানে!
খুঁজে-খুঁজে এসেছি।
বাবা হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে কফি নিলেন। এই বাড়ির একটিমাত্র মেয়ের সঙ্গে বাবার সহজ সম্পর্ক আছে।
একমাত্র শাহানার সঙ্গে কথা বলার সময় বাবার মুখের কঠিন দাগগুলি কোমল হয়ে আসে। শাহানা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নিচে আস টগর, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম।
মামা, আপনার চিনি লাগবে না তো?
নাহ।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শাহানা বলল, খুব একটা বাজে ব্যাপার হয়েছে।
কী?
নীলুদের বাসায় আজ রান্না হয় নি।
রান্না হয় নি মানে?
হয় নি মানে, হয় নি। রান্না করার মতো কিছু ছিল না। ঘরে টাকা পয়সাও ছিল না।
বল কি!
নীলুর বাবার আজ মাসখানেক ধরে চাকরি নেই।
শুনলে কার কাছ থেকে?
নীলুর কাছ থেকেই শুনলাম। নীলু খুব কানাকাটি করছে।
সিঁড়ির উপর আমরা বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। শাহানা মৃদু স্বরে বলল, পৃথিবীতে অনেক রকম কষ্টের ব্যাপার হয়। আমার নিজেরো অনেক দুঃখ-কষ্ট আছে, কিন্তু…।
সারা দিন কিছু খায় নি।
তা জানি না, তবে তাত সম্ভবত খায় নি।
সারা দিন ভাত খায় নি, এরকম লোকের সংখ্যা এদেশে অনেক। কিন্তু পরিচিত কেউ না–খেয়ে আছে, এটা গ্রহণ করা যায় না। প্রচণ্ড রাগ লাগে। বিকালবেলায় দেখছি বাচ্চাগুলি বাগানে ছোটাছুটি করছে। সবচেয়ে ছোটটি আমাকে দেখে ডাকল, এ্যাই এ্যাই। আমি ফিরে তাকাতেই কদমগাছের আড়ালে গিয়ে লুকাল। এটি তার মজার খেলা। আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, ধরে ফেলব। বাচ্চা দুটি দৌড়ে পালাতে গিয়ে জড়াজড়ি করে পড়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে দেখি এক জনের হাঁটুর কাছটায় ছিলে গেছে। কিন্তু কাঁদল না, আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে উৎসাহী গলায় বলল, বাঘ-বাঘ-খেলবে? আর এই বাচ্চারা ভাত খায় নি? আমি দীর্ঘ সময় চুপচাপ শাহানার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাহানা বলল, আমার যা খারাপ লাগছে। আজ নিশ্চয় প্রথম নয়, আগেও হয়তো হয়েছে।
আমি বললাম, রমিজ সাহেব লোকটির প্রকাশ্যে শাস্তি হওয়া দরকার।
রামিজ সাহেব কি করল?
আমি তার জবাব দিলাম না। শাহানা মৃদু স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই।
বল।
নীলুর বিয়ের কথা হচ্ছে। তুমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে নীলুকে রাজি করাও। ওর জন্যে ভালোই হবে। ছেলে খারাপ না।
আমি রাজি কারাবার কে?
তুমি ভালো করেই জান তুমি কে?
শাহানা গা-জ্বালা ধরান শীতল হাসি হাসল। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি বলব। নীলু কোথায়?
এখনই বলতে হবে তেমন কোনো কথা নেই।
ঝামেলা চুকিয়ে ফেলি।
আর যদি সাহস থাকে তাহলে…..