তাই বুঝি?
আর বলেন কেন। খাওয়াদাওয়ার দিক দিয়ে জাপান ভালো। রাইস এবং চিকেনকারী পাওয়া যায়। এক্সেলেন্ট টেষ্ট।
ছোটফুফার কথাবার্তায় আমার গা জ্বালা করতে লাগল। এই লোকটি একটি মরণাপন্ন রুগী দেখতে এসে কোরিয়া-জাপান করছে। আমি বললাম, ছোটফুফা, আমি দোতলায় আছি। দরকার হলে ডাকবেন।
এই দাঁড়াও, আমিও যাব।
আপনি দাদাকে দেখে আসেন।
চট করে দেখেই আসছি। তুমি দাঁড়াও।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ছোটফুফা প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন। চোখ কপালে তুলে বললেন, অবস্থা তো বেশ খারাপা!
খারাপ তো বটেই।
রাত কাটবে না। কি বল?
না কাটারই কথা।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। ডাক্তারদের সার্কেলে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। একটা মেডিকেল বোর্ড তৈরি করা দরকার।
আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, বাবাকে বলেন। বলে নিয়ে যান।
ছোটফুফা চুপ করে গেলেন। সিঁড়ির মাথায় বাবুভাই দাঁড়িয়ে ছিল। বারান্দা অন্ধকার বলে তার মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। ছোটফুফা বললেন, বাবু নাকি? সব অন্ধকার করে রেখেছি কেন?
বাবুভাই জবাব দিল না। ফুফা বললেন, চল, তোমাদের ঘরে গিয়ে বসি।
আমাদের ঘরে বাতি নেই।
বাতি লাগবে না, তোমরা আছ তো?
বাবুভাই বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি থাকব না। টগরকে বলে দেখেন।
আরে, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ঘরে ঢুকেই ফুফা চাপা গলায় বললেন, কিসের গন্ধ? গন্ধ পাচ্ছে না? আমরা জবাব দিলাম না। বাবুভাই বললেন, কি বলতে চাচ্ছিলেন যেন?
আমার শ্বশুর সাহেব সম্পর্কে। শুনলাম তাঁর গ্রামের বাড়ি এবং বিশ বিঘা জমি নাকি স্কুল আর কলেজ ফাণ্ডে দিয়ে যাচ্ছেন?
জানি না, দিতে পারেন।
কি আশ্চৰ্য, তাকে গ্রামের লোকে দালাল বলে, আর তাদের জন্যে এটা করার মানে?
দালালী করেছিলেন, কাজেই দালাল বলে। সেই জন্যে দান-খয়রাত করবেন না?
আরে–তুমি বুঝতে পারছি না, দানটা অপাত্রে হচ্ছে না?
অপাত্রে হবে কেন? গ্রামের গরিব মানুষেরা পাবে।
দান-খয়রাত যোগ্য পাত্রে হওয়া উচিত। ওরা কী বলবে জান? ওরা বলবে, নাম কামাবার জন্যে করেছে। বলবে এবং শালা দালাল বলে গালি দেবে।
দিক না। দাদা তো আর শুনবে না। সে তো ভোগেই যাচ্ছে।
ফুফা অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেন, এক জন মানুষ মারা যাচ্ছে, তাঁর সম্পর্কে এ রকম অশ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলা তোমরা! আশ্চর্য!
শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধার কোনো ব্যাপার না। যেটা সত্যি সেটা বললাম।
মদের গন্ধ পাচ্ছি, মদ খাচ্ছিলে নাকি?
জ্বি, তা খাচ্ছিলাম।
আমি তাদের দু জনকে সেখানে রেখে নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, দু জনে এবার লেগে যাবে। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। খোলা ছাদে বসে একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। কিছু ভালো লাগছে না।
বাড়ির ছাদ
আমাদের এ বাড়ির ছাদটি শুধু যে সুন্দর তাই নয়, অপূর্ব! এর পেছনের সমস্ত কৃতিত্বই শাহানার। ফুলের টব এনে ফুল ফুটিয়ে এমন করেছে যে ছাদে না-ওঠা পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারবে না কত বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সমস্ত ছাদকে চারটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ভাগের নাম গোলাপকুঞ্জ। গোলাপকুঞ্জের ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্যে গদিওয়ালা মোড়া। বৃষ্টির আগে তা ভেতরে নিয়ে আসা হয়। চমৎকার ব্যবস্থা।
আমি ছাদে পা দিয়েই দেখলাম গোলাপকুঞ্জের একটি মোড়াতে বাবা বসে আছেন। তাঁকে দেখেই চট করে নিচে নেমে যাওয়া যায় না। আবার ছাদে ঘোরাঘুরিও করা যায় না। আমি হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবাকে আমরা সবাই ভীষণ ভয় বারি। বাবা বললেন, টগর, নিচের কোনো খবর আছে?
জ্বি-না।
আস এদিকে।
বাবা পাইপ ধারালেন। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
এখানে এসে বস, তোমার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।
আমি এগিয়ে গেলাম। বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার মা মারা যাবার পর আমি খানিকটা লোনলি হয়ে পড়েছি। এই বয়সে মানুষের সবচে বেশি কম্প্যানি প্রয়োজন।
জ্বি, তা ঠিক।
বস তুমি এখানে।
আমি আড়ষ্ট হয়ে বসলাম।
তোমার রেজাল্ট হচ্ছে কবে?
ঠিক জানি না।
বাবা গম্ভীর হয়ে পাইপ টানতে লাগলেন। দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থা। বাবাকে আমরা সবাই ভীষণ ভয় পাই। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা মুশকিল। বাবা হঠাৎ নরম স্বরে বললেন, তোমরা আমাকে এড়িয়ে চল। কী কারণ বল তো।
আমি কুলকুল করে ঘামতে লাগলাম।
তোমার দাদারও এই অবস্থা ছিল। এ সংসারে কিছু মানুষকে একা একা থাকতে হয়–এটা ঠিক না।
আমি সাড়াশব্দ করলাম না।
তোমার দাদার অবস্থা কেমন দেখলে?
বেশি ভালো না।
তাঁর কাছে কে আছেন?
বড়োচাচা আর ছোটচাচা এই দু জনকে দেখে এসেছি।
বাবা ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, গতকাল খবর পেয়েছি, তোমার ছোটচাচা চিটাগাং-এ একটা বাড়ি করেছেন। আমি কিছুই জানতাম না। লুকানর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
আমি কথা বললাম না। বাবা যখন কারো সঙ্গে কথা বলেন তখন কথা বলার ব্যাপারটা তিনিই সারেন, অন্যদের শুধু শোনার দায়িত্ব।
তোমাদের দাদা মারা যাবার পর বড়ো ধরনের ঝামেলা শুরু হবে। তোমার ফুফুরা খুব হৈ-চৈ করবে। বাবা ওদের সম্পত্তি বা টাকা পয়সা কিছুই দিয়ে যান न्नि।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মাস তিনেক আগে উইল করা হয়েছে। তোমার দাদার এ বিষয়ে লজিক খুব পরিষ্কার। তোমার ফুফুদের বিয়ের সময় বাড়ি দেওয়া হয়েছে। ক্যাশ টাকাও দেওয়া হয়েছে। জান নিশ্চয়ই?
জ্বি, জানি।