তুলনামূলকভাবে দাদা অনেক স্বাভাবিক। তিনি যেন কৌতূহলী হয়ে বড়োচাচার কাণ্ড লক্ষ করছেন। বড়োচাচা এক সময় ছুটে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। দাদা লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে মিনুকে ডাকতে লাগলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বদলে গেল। মনে হল তিনি যেন স্পষ্ট দেখছেন মিনু ছোট ছোট পা ফেলে ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। দাদা অবাক বিস্ময়ে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে দেখছেন। তিনি এক বার বললেন, কেমন আছ আম্মা বেটি?
বলার পরপরই দাদার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন মেয়েটি চমৎকার কোনো উত্তর দিয়েছে। আমার একটু ভয়-ভয় করতে লাগল। বাবুভাই বললেন, ডাক্তার সাহেবকে ডাকা দরকার। তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দাদা হাঁপাতে শুরু= করলেন। অদ্ভুত একটা শিস দেবার মতো শব্দ হতে লাগল। প্রদ্যোত বাবু দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। বাইরে গাড়ির শব্দ হল। অক্সিজেন ইউনিট নিয়ে ওরা বোধহয় এসে পড়েছে। আমি বাবুভাইয়ের পেছন-পেছন ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এলাম। মৌলবী লোকটি তখনো চেয়ারে ঠিক আগের মতো বসে আছে। দোয়াটোয়া পড়ছে হয়তো। তার ঠোঁট কাঁপছে দ্রুত ভঙ্গিতে। বাবুভাই কড়া গলায় বলল, কে আপনি?
লোকটি হকচকিয়ে গেল। বাবু ভাই দ্বিতীয় বার বলল, কে আপনি?
প্রশ্নের উগ্র ধরন দেখেই হয়তো লোকটি অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল।
আমি বললাম, উনি এক জন কোরানে হাফেজ।
কোরানে হাফেজ? গোটা কোরান শরিফটা মুখস্থ করেছেন?
জ্বি জনাব।
কী উদ্দেশ্যে করেছেন?
বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে করি নাই।
বাবুভাই বিরক্তির স্বরে বলল, এক সময় এটার দরকার ছিল। মুখস্থ করে মনে রাখতে হত, কিন্তু এখন আর দরকার নেই। কোরান শরিফ পাওয়া যায়। বুঝলেন?
জ্বি, বুঝলাম। তবে জনাব, শখ করে অনেকে অনেক কিছু করে। আমি এক জনকে চিনতাম, সে একটা গোটা কবিতার বই মুখস্থ করেছিল।
বাবুভাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লোকটি মৃদু স্বরে বলল, শখ করে অনেকে অনেক কিছু করে।
আপনি ঠিক বলেছেন। কিছু মনে করবেন না।
জ্বি না, কিছু মনে করি নাই।
আপনার নাম কি?
মোহাম্মদ ইসমাইল।
ইসমাইল সাহেব, আপনাকে চা দিয়েছে?
আমি চা খাই না।
আপনি কি আমার দাদার জন্য দোয়া করছেন?
জ্বি জনাব, করছি। আপনারাও করেন।
ইসমাইল সাহেব বসে পড়ল। অপূর্ব সুরেলা গলায় কোরান পড়তে শুরু করল। যার এত সুন্দর গলা, সে কেন এতক্ষণ মনে মনে পড়ছিল? বাবুভাই অনেকক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। শাহানাও ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল। সে মাথায় কাপড় দিয়েছে। সে দেখলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বাবুভাইয়ের দিকে। যেন কিছু বুঝতে চেষ্টা করছে। ঘরের ভেতর থেকে দাদার গলা শোনা গেল। অন্য রকম আওয়াজ। শুনলেই মনে হয় তাঁর বুকের উপর পাথরের মতো ভারি কিছু একটা চেপে বসেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেটা সরান যাচ্ছে না। ছোটফুফু, কাঁদতে শুরু করেছেন। এই প্রথম বোধ হয় এ বাড়ির কেউ কাঁদল। কান্না খুব ছোঁয়াচে, এক্ষুণি অন্য সবাই কাঁদতে শুরু করবে। আমাদের এ বাড়িতে কোনো শিশু নেই। কেউ এখানে কাঁদে না। দীর্ঘ দিন পর এ বাড়ির মানুষেরা চোখ মুছবে।
ছোটফুফু পাংশু মুখে বাইরে এসে বললেন, টগর, একটা জায়নামাজ দে তো, নিরিবিলিতে একটা খতম পড়বা।
আমি বললাম, ফুফা আসবেন না?
আসবে হয়তো। খবর পেয়েছে।
কোথায় বসে দোয়া পড়তে চান? তিনতলায় যাবেন? কেউ নেই। কিন্তু তিনতলায়।
তাতে কী হয়েছে?
ভয়টয় পেতে পারেন।
ভয় পাব। কী জন্যে? কী সব কথাবার্তা বলিস!
ছোটফুফু অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। আমাদের এই বংশের সবাই অল্পতেই বিরক্ত হয়। অল্পতে রেগে ওঠে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে ছোটফুপু বললেন, বাবা আজ রাত্ৰেই মারা যাবেন!
কেমন করে বলছেন?
ঘরে ঢুকেই আমার মনে হল। ঘরে মৃত্যু বসে আছে।
আমি চুপ করে রইলাম। ছোটফুফু বললেন, কবিরের এই দোঁহাটা পড়েছিস।
কোনটা?
জন্মের সময় শিশুটি কাঁদে, তার আশেপাশের সবাই আনন্দে হাসে। আর মৃত্যুর সময় যে মারা যাচ্ছে সে হাসে, অন্য সবাই কাঁদে।
কথাটা ঠিক নয় ফুফু।
ঠিক না? ঠিক না কেন?
যে মারা যাচ্ছে সে আরো বেশি কাঁদে। কেউ মরতে চায় না।
ছোটফুফু উত্তর দিলেন না। তবে তিনি বিরক্ত হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে–তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত। চোখ তীক্ষ্ণ।
তেতিলায় গিয়ে ফুফুর ভাবান্তর হল। আমার মনে হল তিনি একটুখানি ভয় পেলেন। আমাকে বললেন, উপরটা দেখি খুব চুপচাপ। কেউ নেই মনে হচ্ছে।
জ্বি, সবাই নিচে।
তুই বারান্দায় একটু বসে থাক, দোয়াটা পড়তে আমার বেশি সময় লাগবে না।
ঠিক আছে, বসছি।
বারান্দায় এসে বসামাত্র রূপরূপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। আকাশে যে মেঘ করেছে লক্ষই করি নি। দমকা বাতাস দিতে লাগল। পাঁচটা কাঠি নষ্ট করবার পর সিগারেট ধরান গেল। বসে থেকে শুনলাম, ছোটফুফু উঁচু গলায় কী-একটা দোয়া পড়ছেন। বেশ কিছু দিন ধরেই ছোটফুফু ধর্ম-টর্মের দিকে অস্বাভাবিক ঝুকেছেন! দুই বার গিয়েছেন আজমীর শরিফ। মগবাজারের কোন এক পীর সাহেবের কাছে মুরিদ হয়েছেন। ঘোমটা ছাড়া কোথাও বের হন না। ধর্মে এই অস্বাভাবিক মতির পেছনের কারণ হচ্ছে আমাদের ছোটফুফা।
এক দিন খবরের কাগজে একটা বেশ রগরগে খবর ছাপা হল। তের বৎসরের বালিকা পরিচারিকা ধর্ষণের দায়ে গৃহস্বামী গ্রেফতার। প্রথম পৃষ্ঠায় পুরো দুই কলাম জুড়ে খবর। অর্ধেক পড়বার পর অর্থাৎকে উঠতে হল-গৃহস্বামী আমাদের ছোটফুফা। কোনো পরিচিত ব্যক্তির সম্পর্কে এই ধরনের খবর ছাপা হতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। কী সর্বনাশ!