পরে বলবে।
কথাটা শাহানা প্রসঙ্গে।
দাঁড়িয়ে থাকলেই বাবুভাই কথা বলবে। আমি নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম। শাহানা প্রসঙ্গে বাবুভাইয়ের কী বলার থাকতে পারে, তা ঠিক বোঝা গেল না। শাহানা সেই জাতীয় মেয়ে, যাদের প্রসঙ্গে কারো কিছু বলার থাকে না। এদের চোখের দৃষ্টি হয় শীতল, হৃদয়ও থাকে। শীতল। এরা শান্ত ভঙ্গিতে সংসারের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে। আমাদের বুড়ো সম্রাট শাহজাহানের কাছে সারা দুপুর বসে থাকে জাহানারা সেজে। যখনই প্রয়োজন মনে করে, তখনি গলার স্বর অস্বাভাবিক শীতল করে আমাকে উপদেশ দিতে আসে। যেমন দিন সাতেক আগে হঠাৎ আমাকে এসে বলল, গতকাল নীলুর সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল তোমার?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন?
দেখলাম নীলু। খুব হাসছে।
জোক বলছিলাম একটা। মজার গল্প।
কি জোক?
তার দরকারটা কী?
দরকার আছে। একটা কাঁচা বয়সের মেয়ে। ওর সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি করা ঠিক না।
অসুবিধাটা কোথায়?
অল্পবয়েসী মেয়েরা অতি সহজেই উইকিনেস গ্রো করিয়ে ফেলে এবং পরে কষ্ট পায়। গরিব-দুঃখী মানুষের মেয়ে, এদের নিয়ে ছেলেখেলা করা ঠিক না।
তাই বুঝি?
হুঁ।
শাহানা আমাকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে গেল।
রাগে গা জ্বলতে লাগলো আমার।
ছোটফুফু চলে এসেছেন
ছোটফুফু চলে এসেছেন। সঙ্গে অল্পবয়স্ক মৌলবী এক জন। লোকটির মাথায় বেতের একটা টুপি। অত্যন্ত ফর্স একটা পাঞ্জাবি আছে গায়ে। (এই জাতীয় লোকদের গায়ে সাধারণত এত ফর্সা জামাকাপড় থাকে না।) পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেলের বদলে পরিষ্কার একজোড়া চটি জুতো। লোকটি বারান্দায় একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ছে দেখে বোঝা যায়, কিছু একটা পড়ছে মনে মনে। আমাকে দেখে অত্যন্ত পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, আসসালামু আলায়কুম। ভালো আছেন?
আমি জবাব না দিয়ে দাদার ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘর ভর্তি মানুষ। দাদা আমাকে ঢুকতে দেখেই বললেন, কে? বাবু?
জ্বি-না, আমি টগর।
ও তুই। বাবু কই?
আসছে।
বড়োচাচা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, লাটসাহেবের হয়েছেটা কি? এতক্ষণ লাগে?
দাদা শান্ত স্বরে বললেন, চিৎকার করিস না। আসুক। ধীরেসুস্থে। তাড়া নেই কোনো!
ছোটচাচা বললেন, সন্ধ্যা থেকে তাকে দেখি না, সে আছে কোথায়?
দাদা ক্লান্ত স্বরে বললেন, আমার শখ ছিল বাবুর একটা বিয়ে দিয়ে যাই।
বড়োফুফু। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বাবু এখন বিয়ে করবে কি? রোজগারপাতি কোথায়?
দাদা বিরক্ত চোখে তাকালেন। বড়োফুফু বললেন, ফরিদের বিয়ে দেওয়া দরকার। ওর বিয়েটা নিজে দাঁড়িয়ে দিয়ে যান। আপনার শরীরটা একটু সুস্থ হলেই কথাবার্তা ফাইনাল করব। জাস্টিস বি. করিম সাহেবের ছোট মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে……।
দাদা ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাবু কোথায়? তাঁর ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, নিঃশ্বাস নিতে বোধহয় কষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে আবার।
দাদা বললেন, তোমরা কেউ একটা গামছা দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দাও।
ছোটফুফু, দৌড়ে রুমাল ভিজিয়ে আনলেন। প্রদ্যোত বাবু বললেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
অক্সিজেনের ব্যবস্থা হচ্ছে। অক্সিজেন দেওয়া শুরু হলেই আরাম হবে।
ডাক্তার, শান্তিতে মরতে দাও। ঝামেলা করবে না।
ছোটফুফু বললেন, এইসব কথা কেন বলছেন বাবা?
মা, সময় শেষ হয়ে এসেছে।
ছোটফুফু, চোখ মুছতে লাগলেন। বাবুভাই এলেন সেই সময়। দাদা হাত ইশারা করলেন। বসতে বললেন তাঁর কাছে। ক্লান্ত স্বরে বললেন, সবাই আছে। এইখানে? বড়োচাচী বললেন, জ্বি আছে। দাদা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন, ছোটন কোথায়?
ছোটন হচ্ছে আমার ছোটচাচী, দাদার খুব প্রিয়পাত্রী। বড়োফুফু, বললেন, ছোটন গেছে চিটাগাং। কী যে এদের কাণ্ড! এমন অসুখবিসুখের মধ্যে কেউ বাইরে যায়? ছোটচাচা বললেন, সে কাল আসবে। দাদা বললেন, কাল পর্যন্ত আমার সময় নেই। তোমরা কেউ গিয়ে আলমারি খোল।
বড়োফুফু বললেন, বাইরের লোকজন না থাকাই ভালো। এই মেয়ে, নীলু না তোমার নাম? তুমি বাইরে যাও।
দাদার ভ্রূকুঞ্চিত হল। তিনি কিছুই বললেন না। প্রদ্যোত বাবুও উঠে দাঁড়ালেন, আমি বারান্দায় গিয়ে বসছি।
আলমারি খোলা গেল না। বড়োচাচা এদিক-সেদিক নানাভাবে চাবি ঘোরালেন। দরজা ঝাঁকালেন। কিছুতেই কিছু হল না। দাদা ক্লান্ত স্বরে বললেন, তুই কোনোদিনই কিছু পারলি না। চাবিটা রহমানের কাছে দে।
বড়োচাচা চাবি দিলেন না। আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন আলমারির দরজার গায়ে, যেন এটা খোলার উপর তাঁর বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। দেখতে–দেখতে তাঁর কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘম পড়তে লাগল। তিনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। বড়োফুফু, অধৈৰ্য হয়ে বললেন, দেখি, চাবিটা দাও আমার কাছে। বড়োচাচা দিলেন না। চোখ ছোট করে তাকালেন। যেন কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারছেন না। বাবুভাই বললেন, ফুফু, বাবাকে খুলতে দিন। বড়োফুফু। ফোঁস করে উঠলেন, সে এটা খুলবে কীভাবে? তার সে-বুদ্ধি থাকলে তো কাজই হত।
একটা সামান্য ব্যাপারে আবহাওয়া বদলে গেল। বড়োচাচা এমন করতে লাগলেন, যেন স্টীলের আলমারি খুলতেই হবে। আমি লক্ষ করলাম, তাঁর হাত কাঁপছে। ফুফু বিরক্তির একটা শব্দ করলেন। বড়োেচাচার চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো হয়ে গেল। জীবনে তিনি অসংখ্য বার পরাজিত হয়েছেন, কখনো কিছুমাত্র বিচলিত হন নি। আজ তাঁর এরকম হচ্ছে কেন কে জানে?