আজকের মতো শেষ। তুমি কি অফিস থেকে আসছ?
না। নিউ মার্কেট থেকে। আমাদের জি.এম. সাহেবের সঙ্গে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম। আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে তিনি শাড়ি কিনলেন। আমাকে পছন্দ করে দিতে হলো।
মইন হাসিমুখে বলল, উনি নিশ্চয় এর মধ্যে তোমাকে বলেছেন যে তাঁর জীবন কী রকম বিষময়। বলেন নি?
বলেছেন।
ঐ গল্পটি কি করেছেন–তিনি তাঁর স্ত্রীর জন্যে শখ করে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলা সেই শাড়ি কেটে তিনটি লুঙ্গি বানিয়ে তাঁকে প্রেজেন্ট করলেন। এই গল্প কি শোনা হয়েছে, না শোনা হয় নি?
মীরা বলল, শোনা হয়েছে।
মইন বলল, এইসব গল্প এক বৰ্ণও বিশ্বাস করবে না। সুন্দরী মহিলাদের সহানুভূতি আদায়ের জন্যে এই গল্প তিনি করেন। ভদ্রলোক হার্মলেন্স। তুমি নিশ্চিন্ত মনে তাঁর সঙ্গে ঘুরতে পারো। কোনোদিন ভুলেও সে তোমার হাত ধরবে না। সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে গল্প করার আনন্দই তাঁর একমাত্র আনন্দ। তাঁর পরিবারিক জীবনও খুব ভালো। ভদ্রলোকের স্ত্রী একজন রূপবতী মহিলা এবং অত্যন্ত ভালো মহিলা। মীরা তুমি মনে হয় আমার কথা শুনে হকচকিয়ে গেছ।
কিছুটা হকচকিয়ে গেছি তা ঠিক।
বুঝলে মীরা, পৃথিবীটা আসলে মোটামুটি ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা। এখন বল তোমার পরিকল্পনা কী?
আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। আপনার কল্যাণে চাকরি হয়েছে। আমি তার জন্যে আপনাকে থ্যাংকস্ দিতে এসেছি। এর বেশি কিছু না।
তুমি এমনভাবে ‘না’ বললে, যাতে মনে হচ্ছে এর বেশি কিছু হলে তোমার আপত্তি আছে। বস, আমার সঙ্গে চা খাও। চা খেয়ে চল ঘুরতে বের হই। রাতে ডিনারের পর তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব। ভয়ের কিছু নেই। আমিও তোমাদের জি.এম. সাহেবের মতো হার্মলেন্স। ভালো কথা, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে মনটা খুব খারাপ। কী হয়েছে বল তো?
মীরা বলল, কিছু হয় নি, আমি বেশিক্ষণ থাকব না। চা খাব তারপর বাসায় চলে যাব। কাজ আছে।
কাজ পালিয়ে যাচ্ছে না। আমি পালিয়ে যাচ্ছি। কাজেই আর কোনো কথা নয়। আমার পরিকল্পনা কী ছিল জান? পরিকল্পনা ছিল সন্ধ্যার পর তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাব। তোমাদের বাসায় আই মিন তোমার ভাইয়ের বাসায় খবর দিয়ে রেখেছিলাম। তুমি যখন এলে তখন ভাবলাম খবর পেয়ে নিজেই এসেছি। তুমি হয়তো লক্ষ কর নি যে তোমাকে দেখে আমি মোটেও অবাক হইনি। পরে অবশ্যি বুঝলাম যে নিজ থেকেই এসেছি। খবর পাও নি। এর পরেও যদি যেতে না চাও তাহলে আমার হাতে আরেকটি কঠিন অস্ত্ৰ আছে।
কী অস্ত্ৰ?
আজ আমার জন্মদিন। তুমি এই দিনটাও ভুলে গেলে এটা খুবই দুঃখের কথা। আমার ধারণা ছিল আমার জন্যে অনেকখানি আবেগ তুমি সব সময় ধরে রাখবে। ধারণা দেখা যাচ্ছে ঠিক না। তুমি সব ভুলেটুলে বসে আছ।
তাই কি ভালো না?
জানি না, হয়তো ভালো। এখন বল তুমি যাবে, না যাবে না।
চলুন যাই। তুমি খুব অনাগ্ৰহ নিয়ে আমার সঙ্গে রওনা হচ্ছে। আমি হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি এই অনাগ্রহ তোমার থাকবে না।
বাজিতে আপনি হারবেন। আজকাল কোনো কিছুতেই আগ্রহ বোধ করি না।
কেন কর না তাও জানতে চাই।
জানতে চান কেন?
আজকের অনাগ্রহের পেছনে–অনেকদিন আগে আমার ঘরে যা ঘটেছিল তার কোনো যোগ আছে কিনা জানতে চাই। আমি নিজে অত্যন্ত সুখী মানুষ। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই।
দুজন হাঁটতে হাঁটতে রওনা হলো। মইনের ইচ্ছা অনেকক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যাবার পর তারা রিকশা নেবে। রিকশায় করে ঘুরতে ঘুরতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন কোনো চাইনিজ রেস্তোরায় আধো আলো আধো আঁধারে রাতের খাবার শেষ করবে।
মীরা লক্ষ করল। মইনকে অসম্ভব খুশি খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে সে তার আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না। মীরাকে সে কোনো কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না। অনবরত কথা বলে যাচ্ছে–
মীরা, জার্মান কালচারাল ইন্সটিটিউটে একটা ছবি কিনেছিলাম তোমার মনে আছে? নগদ দাম দিয়ে কিনেছিলাম। এক্সিবিশনি শেষে ছবি নিয়ে আসার কথা ছিল। আমি আর ছবি আনতে যাই নি। ঐ আর্টিস্ট যেহেতু আমার ঠিকানা জানে না–ছবি দিয়ে যেতেও পারছে না। হা-হা-হা।
এতে খুশি হচ্ছেন, কারণটা কী?
খুশি হচ্ছি কারণ আর্টিস্ট সাহেবকে এক ধরনের মানসিক কষ্ট দিতে পারছি। সে ঐদিন আমাকে সূক্ষ্মভাবে অপমান করেছিল। কঠিন অপমান। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম শোধ নেব। এখন নিচ্ছি। বেচারা এখন ছবিটা নিয়ে পড়েছে বিপদে। নিজের কাছে ছবিটা রাখতে হচ্ছে। যতবার তাকাচ্ছে ছবিটার দিকে ততবার আমার কথা মনে হচ্ছে। মনটা খারাপ হচ্ছে–টাকা দিল অথচ ছবি নিল না। কঠিন মানসিক চাপ। হা-হা-হা।
আপনি মানুষটা বেশ অদ্ভুত।
অদ্ভুত না-ক্ৰয়েল। নিষ্ঠুর। শুধু সদ্গুণ নিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয় না–এইসবও কিছু কিছু লাগে। যাদের ভেতর শুধু সদ্গুণ, মানুষ হিসেবে অনেক নিচের দিকে তাদের অবস্থান।
কী পাগলের মতো কথা বলছেন?
পাগলের মতো কথা বলছি না। ভেবেচিন্তে বলছি। তোমাকে এই কথাগুলো বলার পেছনে আমার একটা উদেশ্যও আছে। কী বলছি মন দিয়ে শোন। খুব মন দিয়ে। একজন মানুষ যার ভেতরে মহৎ গুণাবলি ছাড়া কিছুই নেই, রাগ নেই, হিংসা নেই, ঘৃণা নেই সে কী করে জান? সে আশপাশের মানুষদের অসম্ভব কষ্ট দেয়। আমরা তাকে এড়িয়ে চলি। ক্ষেত্রবিশেষে পরিত্যাগ করি। কারণ আমরা তাকে সহ্য করতে পারি না।