মশারি ফেলবে না?
দরজা-জানালায় নেট লাগানাে–মশা আসবে না, তাছাড়া ঘরে ফুল থাকলে মশা আসে না। ফুলের গন্ধ মশারা সহ্য করতে পারে না।
তাই নাকি? জানতাম না তো!
ঘুম পেলে শুয়ে পড়।
মনজুর শুয়ে পড়ল। এক ঘুমে রাত কাবার। মনজুরের ধারণা, সবচে’ আরামের ঘুম সে ঘুমিয়েছে বাসর রাতে।
কাফে লবঙ্গ চা খেতে খেতে মনজুর আজ সারাদিনে কী কী করবে। ঠিক করে ফেলল। তার ভিজিটিং কার্ডের উল্টো পিঠে এক দুই করে লিখল,
(১) অফিস, সকাল দশটা।
(২) বড়মামার সঙ্গে কথাবার্তা এবং তার অফিসে দুপুরের খাওয়া।
(৩) খালাকে চিঠি লেখা এবং নিজ হাতে পোস্ট করা।
(৪) ইদরিসের সঙ্গে ঝগড়া।[ সন্ধ্যায়, তাকে তার বাসায় ধরতে হবে।]
(৫) মীরার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা। [রাত দশটার পর।]
এই জাতীয় একটা লিস্ট মনজুর প্রতিদিন ভোরেই করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছেলিষ্ট অনুযায়ী কোনো কাজই শেষ পর্যন্ত করা হয় না। তবু লিস্টটা করলে মনে এক ধরনের শান্তি পাওয়া যায়।
লিষ্টের পাঁচ নম্বরে মীরার সঙ্গে কথা বলা। রাত দশটার পরে তাকে সব সময় পাওয়া যায় না। এগারটার পর হলে মোটামুটি নিশ্চিত যে পাওয়া যাবে। শীতের রাতে এগারটার পর টেলিফোন জোগাড় করাই এক সমস্যা। সব দোকানপাট বন্ধ। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে করা যায়। তবে তার জন্যে বাড়ির ভাড়া ক্লিয়ার করা দরকার। আজ রাতে বাড়িভাড়া নিয়ে যদি যাওয়া যায় তাহলে উঠে আসার সময় হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলা যেতে পারে, ভাই সাহেব! টেলিফোনটা ঠিক আছে?
উনার টেলিফোন অবশ্যি বেশিরভাগ সময়ই খারাপ থাকে। নিজেই খারাপ করে রাখে। কিনা কে জানে!
তারচে’ এখন চলে গেলে কেমন হয়? মীরাকে ভোরবেলার দিকে সব সময় পাওয়া যায়। মনজুর ভিজিটিং কার্ড বের করে পাঁচ নম্বর আইটেমে টিক চিহ্ন দিল।
মীরা সহজ স্বরে বলল, তুমি এত ভোরে!
মনজুর বলল, ভোর কোথায়। আটটা চল্লিশ বাজে।
কোনো কাজে এসেছ?
ভাবলাম সেপারেশনের টার্মস এন্ড কন্ডিশনসগুলো নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করি। মীরা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, টার্মস এন্ড কন্ডিশনস মানে? ঠাট্টা করছি নাকি? তোমার রূঢ় আমি কি কিছু চাচ্ছি? তােমার এমন কােনাে রাজত্ব নেই অর্ধেক আমাকে দিয়ে
তা ঠিক, তবু আইনের কিছু ব্যাপারস্যাপার আছে।
তার জন্যে তো গত মাসের সাতাশ তারিখে ভাইয়া সুপ্রিম কোর্টের লইয়ার এম. জামানকে ঘরে বসিয়ে রেখেছিলেন। তোমার আসার কথা ছিল, তুমি আস নি।
সেটা আমি এক্সপ্লেইন করেছি। হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ে গেল।
কী তোমার অফিস আর কী তার জরুরি কাজ! একটা কথা পরিষ্কার করে বল তো–সেপারেশনে তোমার কি ইচ্ছা নেই?
আরে কী বলে! ইচ্ছা থাকবে না কেন? দুজন মিলেই তো ঠিক করলাম। চা খাওয়াতে পার?
মীরা চা আনতে উঠে গেল। তাকে আজ অপূর্ব দেখাচ্ছে। বিয়ের সময় এতটা সুন্দর ছিল না। আলাদা হবার পর থেকে সুন্দর হতে শুরু করেছে। খানিকটা রোগও হয়েছে। রোগার জন্যেই লম্বা লম্বা লাগছে নাকি? চেহারায় চাপা আনন্দের আভা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মীরা এখন সুখে আছে। সমস্ত চেহারায় মায়াবতী মায়াবতী ভাব। নীল শাড়ির জন্যেও হতে পারে। ধবধবে সাদা ব্লাউজের সঙ্গে নীল শাড়ি পরলে মেয়েদের মধ্যে একটা আকাশ আকাশ ভােব চলে আসে। শাড়িটা আকাশ, ব্লাউজ হলো পূর্ণিমার চাঁদ। উপমা নিখুঁত হলো না। রাতের আকাশ নীল হয় না। হয় ঘন কৃষ্ণবর্ণ।
নাও, চা নাও। চায়ের সঙ্গে আর কিছু দেব?
না।
নাশতা খেয়ে এসেছ?
হুঁ।
কোথায় খেলে? তোমার সেই কাফে লবঙ্গ?
হুঁ।
এক অক্ষরে জবাব দিচ্ছি কেন? আমরা আলাদা থাকাছি বলে কথা বলা যাবে না। তা তো না। কী কথা ছিল? সেপারেশনের পরে আমাদের যদি পথেঘাটে দেখা হয় তাহলে আমরা সিভিলাইজড় মানুষের মতো বিহেভ করব।
তা অবশ্যই করব।
এক ধরনের সাধারণ বন্ধুত্ব আমাদের মধ্যে থাকবে। তুমি চা খােচ্ছ না কেন? চিনি বেশি হয়েছে?
না। চিনি ঠিক আছে।
তোমাকে অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। তোমার শরীরে অসুখ অসুখ গন্ধ।
মনজুর কিছু না বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেটের কড়া ধোঁয়ায় অসুখ অসুখ গন্ধটা যদি তাড়ানো যায়। মীরার ঘাণশক্তি কুকুরের চেয়েও প্রবল। যখন অসুখ অসুখ গন্ধ বলছে তখন বুঝতে হবে ঠিকই বলছে।
কথার জবাব দিচ্ছে না কেন? অসুখ নাকি?
আরে না। বিনা পেস্টে দাঁত মেজেছি–গন্ধ যা পাচ্ছি। আমার মনে হয় মুখ থেকে পাচ্ছ।
মুখের গন্ধ আমি চিনি। তোমার গা থেকে জুর জ্বর গন্ধ আসছে। সিগারেটও মনে হয় প্রচুর খাচ্ছ।
হেভি টেনশনে থাকি। সিগারেটের ধোয়ার উপর দিয়ে টেনশানটা পার করার চেষ্টা করি।
কীসের এত টেনশান?
আছে অনেক। আচ্ছা তোমাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করি, ধর একজন লোকের খুব নিকট কোনো আত্মীয় মারা গেছে। তাকে সান্তনা দিতে হবে। কী বলে সান্ত্বনা দিবে?
কে মারা গেছে?
কে মারা গেছে সেটা জরুরি না। কী কথা বললে সে সান্ত্বনা পাবে সেটা বল।
কোনাে কথাতেই সে সান্ত্বনা পাবে না। তুমি যদি তার গায়ে হাত দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাক তাহলে খানিকটা সাত্ত্বিনা পেতে পারে।
মনজুর উঠে দাঁড়াল। মীরা সঙ্গে সঙ্গে উঠল না। বসে রইল; মনজুর বলল, আজ উঠি।
মীরা বলল, তুমি না। টার্মস এন্ড কন্ডিশনস নিয়ে আলাপ করতে এসেছিলে? এখন চলে যােচ্ছ যে?