কেন করছ এসব?
আগ্রহ করে তারা নানান চিকিৎসার কথা বলে। তাদের খুশি করার জন্যে কিছুতেই না করি না। মানুষকে খুশি করতে আমার ভালো লাগে। তুমি কিছু খাবে মীরা?
না।
পেঁপে খেতে পারো। কুদ্দুস নামে আমার এখানে একজন কর্মচারী আছে–সে রোজ নিউ মার্কেট থেকে পেঁপে কিনে এনে বলছে, নিজের গাছের পেঁপে স্যার। বাবার হাতে পোঁতা গাছ। কুদ্দুস খুব পিতৃভক্ত। তার সব গাছই থাকে বাবার হাতে পোঁতা।
মীরা তার ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, রসিকতা করার চেষ্টা করছি বলে মনে হয়।
রসিকতা পছন্দ হচ্ছে না?
না। আজ তাহলে উঠি।
মীরা উঠে দাঁড়াল।
মনজুর দুঃখিত গলায় বলল, সত্যি সত্যি উঠছ? বস না একটু। আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাও।
এক জায়গায় যাব। দেরি হয়ে যাবে, সন্ধ্যার পর রিকশায় যেতে ভয় ভয় লাগে।
আমার সঙ্গে গাড়ি আছে–যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাবে।
ও আচ্ছা, তোমার তো এখন গাড়ি আছে। ভুলেই গিয়েছিলাম। তাহলে খানিকক্ষণ বসা যায়। বল, চা আনতে বল। ভালো কথা, ডোনার পাওয়া গেছে?
হ্যাঁ। নাম আমানুল্লাহ।
মীরা অতি দ্রুত চা শেষ করে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল। মনজুর বলল, চল আমিও তোমার সঙ্গে যাই। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। তুমি যাবে কোথায়–মইন সাহেবের কাছে?
মীরা খানিকটা হকচকিয়ে গেল।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি উনাকে চেন?
উনি একদিন আমার কাছে এসেছিলেন।
কী জন্যে?
এমনি বোধহয় এসেছিলেন। কথাবার্তা বলার জন্যে।
মীরা নরম গলায় বলল, তাঁর প্রতি এক সময় আমার ভয়ঙ্কর রকম টান ছিল তা কি উনি বলেছেন?
মনজুর হেসে বলল, সবই বলেছেন। কিছুই বাদ দেন নি। আমার কি মনে হয় জান? আমার মনে হয়। ভদ্রলোক তোমাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চান। তোমাকে কী করে বলবেন বুঝতে পারছেন না।
তুমি তোমার উর্বর মাথা থেকে এটা বের করলে?
হ্যাঁ। আমার কিডনি ফেল করতে পারে, ব্রেইন ফেল করে নি।
করেছে। কারণ তুমি জান যে মইন ভাই তাঁর স্ত্রী এবং বাচ্চাদের নিয়ে খুব সুখে আছেন।
মনজুর সহজ গলায় বলল, আমি যতদূর জানি তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে লুসিয়ানায় চলে যাবার পরই তিনি দেশে এসেছেন। ফিরে যাবেন না বলেই এসেছেন।
উনি নিজে তোমাকে বললেন?
হ্যাঁ। এবং আমার কি মনে হয় জান মীরা, আমার মনে হয় তোমার উচিত তাঁকে বিয়ে করা। এই ভদ্রলোকের প্রতি তোমার যে প্ৰচণ্ড মোহ ছিল তার সবটাই এখনো আছে। আছে বলেই আমার সঙ্গে থাকতে পারলে না। আমার মধ্যে তুমি মইন সাহেবের ছায়া দেখতে চেয়েছিলে। তা কি সম্ভব? আমি হচ্ছি আমি।
মীরা কিছু বলল না।
গাড়িতে উঠেও চুপ করে রইল। মনজুর বলল, মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ করিয়ে দিয়েছি। সরি।
মীরা বলল, সরি হবার কিছু নেই।
মনজুর বলল, তোমার মোহ প্রসঙ্গে যা বললাম তা কি ভুল?
না, ভুল না।
ভুল না হলে তুমি এত লজ্জিত বোধ করছ কেন?
লজ্জিত বোধ করছি না তো!
করছি। খুব মন খারাপ করেছ। প্লিজ মন খারাপ করবে না। আমার সঙ্গে তিনটি বছর তোমার খুব খারাপ কেটেছে। খারাপের পর ভালো আসে। সামনের দিনগুলো তোমার ভালো যাবে। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত।
মনজুর মীরাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
মইন বারান্দায়
মইন বারান্দায় কাগজ, কেচি এবং গাম নিয়ে এসেছে। তৈরি করছে কাগজের এরোপ্লেন মডেল। তার সামনে একটা বই খোলা। বইয়ে লেখা মাপমতো প্রতিটি মডেল তৈরি হচ্ছে এবং তা সঙ্গে সঙ্গে আকাশে উড়িয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাকে ঘিরে নানান বয়সী কিছু বাচ্চাকাচ্চা বসে আছে। তাদের বিস্ময় এবং মুগ্ধতা সীমাহীন।
মইন মীরাকে দেখে সহজ গলায় বলল, এস মীরা, এস। প্লেন বানাচ্ছি। মইনের গলায় কোনো বিস্ময় নেই। মনে হতে পারে সে এই মুহুর্তে মীরার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। বিস্মিত না হবার অভিনয় দুরূহ অভিনয়। এই মানুষটি সেই অভিনয় এত চমৎকার করছে কী করে? নাকি সে আসলেই বিস্মিত হয় নি। ধরেই নিয়েছিল মীরা যেকোনোদিন আসবে। মইন কাগজ কাটতে কাটতে বলল, এই মোড়াটায় আরাম করে বাস। আমার চারপাশে যারা বসে আছে তারা আমার নেফিউ এবং নিস। এদেরকে আমি এই মুহূর্তে এরোডায়নামিক্স শিখাচ্ছি। সামান্য কাগজের তৈরি প্লেন বাতাসে ভর করে কুড়ি থেকে পঁচিশ গজ যেতে পারে যদি ঠিক ডিজাইনে তাদের তৈরি করা হয়। এই দেখ এটাকে দেখ–ফড়িঙের মতো স্লিম বডি, আকাশে ভেসে থাকার ক্ষমতা দেখলে তুমি হকচকিয়ে যাবে।
মইন কাগজের প্লেন আকাশে ছুড়ে মারল। সেই প্লেন সত্যি সত্যি উড়তে উড়তে বাড়ির কম্পাউন্ড ছাড়িয়ে রাস্তার দিকে রওনা হলো। পেছনে পেছনে ছুটে গেল শিশুর দল। মইন মীরার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, কেমন আছ?
ভালো।
কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ না। এমনি এসেছ?
এমনি এসেছি। আপনার না চলে যাবার কথা ছিল?
যাওয়া হয় নি। আরো মাসখানিক থাকব।
আমাদের জি.এম. বলছিলেন, পুরোপুরি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাও নাকি আছে।
না। কথার কথা বলছিলাম। সেটাকেই ভদ্রলোক বিশ্বাস করে বসে আছেন। বর্তমান বাংলাদেশের সমস্যা কি জান? সিরিয়াসলি যেসব কথা তুমি বলবে সেসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু রসিকতা করে তুমি যদি কিছু কথা বল, যদি casual remarks কিছু করা সবাই বিশ্বাস করবে। চল ভেতরে বসে কথা বলি।
প্লেন বানানো শেষ?