অনুমান করতে পারেন?
না—তাও পারছি না।
যে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে সে আমার দিকের আত্মীয়। আমার দিকের আত্মীয়ের কোনো কর্মকাণ্ডে সে থাকবে না। বিয়েতেও সে যাবে না–সাজগোজ সে করবে। ঠিকই। গাড়িতে উঠার আগ মুহূর্তে বলবে–মাথা ধরেছে, বমি বমি লাগছে। বলেই ছুটে বাথরুমে ঢুকে গলায় আঙুল দিয়ে হড়হড় করে বমি করবে। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হবে–থাক যেতে হবে না। এই হচ্ছে আমার জীবন। অনেক কথা আপনাকে বলে ফেললাম, চলুন যাওয়া যাক।
শাড়ি কেনা হয়ে গেল পনের মিনিটে। দোকানদার কয়েকটা শাড়ি মেলে ধরল। মীরা সাদা জামদানির উপর নীল লতাপাতা আঁকা একটা শাড়ি তুলে নিয়ে বলল— এইটা নিন স্যার। চমৎকার।
জি.এম. সাহেব বললেন, আরেকটু ঘুরেফিরে দেখলে হয় না?
শুধু শুধু হাঁটহঁটি করে কোনো লাভ নেই–এটা ভালো শাড়ি। আপনি আমার রুচির উপর ভরসা করেছেন–এটাই নিন। আমি এখান থেকে বিদায় নেব। বইয়ের দোকানে খানিকক্ষণ ঘুরব।
আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি।—তারপর আপনাকে নামিয়ে দেব।
স্যার কোনো দরকার নেই।
মীরা বইয়ের দোকানগুলাতে বেশ কিছু সময় কাটাল। তিনটা বই কিনল— তিনটিই কবিতার। বই তিনটিই তার আছে। তবু কিনল কেন কে জানে? মানুষের কিছু কাজকর্ম আছে চট করে যার ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয় না। অবচেতন মনে কোনো ব্যাখ্যা হয়তো আছে যা এই মুহুর্তে মীরা নিজেও জানে না।
মীরা ঘড়ি দেখল। মোটে চারটা বাজে। কী করা যায়? মনজুরের খোঁজে কি একবার যাবে? অফিস ছুটি হয়ে গেছে। তাকে এখন অফিসে পাওয়া যাবে না। আগের বাসায় গেলেও তাকে পাওয়া যাবে না। বাসা বদলে সে তার মেজো মামার কাছে গিয়ে উঠেছে নিশ্চয়ই। সেখানে যাওয়া যেতে পারে। তবে ঐ লোকটিকে তার নিতান্তই অপছন্দ। অশিক্ষিত, অশালীন গ্ৰাম্য ধরনের মানুষ। মনজুরের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে মীরা যখন তার বাবার বাড়িতে চলে এসেছে তখনকার ঘটনা। বদরুল আলম এক সন্ধ্যাবেলায় দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত। অতি নম্র গলায় বললেন, মা’র কাছে ছেলের একটা আবদার। আবদার রক্ষা না করলে ছেলে এই বাড়ি থেকে যাবে না। মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। হাতি দিয়ে টেনেও ছেলেকে নড়াতে পারবে না মা।
মীরা শুকনো গলায় বলেছে— বলুন কী আবদার।
মনজুরের কাছে শুনলাম–তুমি ওকে ছেড়ে এই বাড়িতে চলে এসেছি। এখন মা জননী তুমি আমার সঙ্গে চল। বাইরে একটা বেবীট্যাক্সি আছে। দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
বাইরে বেবীট্যাক্সি আছে?
হ্যাঁ মা।
দেখুন মামা, আমি রাগের মাথায় হুট করে চলে আসি নি। আমি পুরো এক বছর এটা নিয়ে চিন্তা করেছি। ভেবেছি। রাতের পর রাত নির্মুম কাটিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মনজুরের সঙ্গে কথা বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মনজুর কি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে?
না–আমি নিজেই এসেছি। মনজুর যদি শোনে সে রাগ করবে। তাকে তুমি এই বিষয়ে কিছু বোলো না।
আমি কিছুই বলব না। আপনি চা খান। চা খেয়ে চলে যান।
বদরুল আলম সাহেবের নিশ্চয়ই অনেক কিছু বলার ছিল। সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। মীরার শীতল চোখের সামনে সব এলোমেলো হয়ে গেল। চা না খেয়েই চলে গেলেন। দ্বিতীয় দিন আবার এলেন সঙ্গে দু কেজি মিষ্টি। তৃতীয় দিন আবার সঙ্গে সেই মিষ্টি।
মীরা বাধ্য হয়ে মনজুরকে বলল সে যেন তার মামাকে সামলায়। নির্বোধ ধরনের মানুষকে সামলানো বড়ই কঠিন কাজ।
সেই মামার কাছে মনজুরের খোঁজে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করবেন। ভেবে বসবেন–সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে; আবারো হয়তো লোক পাঠিয়ে দু কেজি মিষ্টি আনাবেন। কোনো দরকার নেই। তারচে’ মইনের কাছে যাওয়া যেতে পারে। তাকে পাওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। তবু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। এই চাকরিটি তার কারণেই হয়েছে। সেই হিসেবে ধন্যবাদ তো তার প্রাপ্য।
নিউ মার্কেট থেকে বের হয়ে মীরা রিকশা নিল। রিকশায় উঠতে উঠতে মনে হলো–ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না। বেঁচে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, বেড়ানো–সব অর্থহীন মনে হচ্ছে–কী যেন সেই কবিতাটা?
অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়…
রিকশাওয়ালা বলল, কই যাইবেন আম্মা?
মীরা চমকে উঠল। এত মিষ্টি গলায় অনেক দিন তাকে কেউ আম্মা ডাকে নি। অজানা অচেনা অপুষ্টিতে জড়োজড়ো বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা এত মিষ্টি করে তাকে আম্মা ডাকিল? এত মমতা ছিল তার গলায়?
মীরা বলল, আপনি সোজা যেতে থাকুন। আমি আপনাকে বলব।
জ্বি আচ্ছা আম্মা। মীরার মন ভালো হতে শুরু করেছে। কেন?
মীরা জানে না। মইনের বাসায় যাবার আগে একবার কি মনজুরের অফিস দেখে যাবে? এত বড় কোম্পানির মালিক সে, নিশ্চয়ই পাঁচটা বাজতেই বাসায় চলে যায় না। তাকে নিশ্চয়ই অনেক কাগজপত্র সই করতে হয়।
আসব?
মনজুর হাসিমুখে বলল, এস।
তোমার বসগিরি দেখতে এলাম।
খুব ভালো করেছ।
শরীর কেমন?
ভালো। মাঝখানে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ডায়ালিসিস করার পর ঠিক আছে। সেই সঙ্গে চলছে আয়ুৰ্বেদী চিকিৎসা—‘নলাদি ক্বাথ’ খাচ্ছি।
‘নলাদি ক্বাথ’টা কী জিনিস?
গোবর পানিতে গুললে যে বস্তু হয় তার নাম নলাদি ক্বাথ, কিডনির মহৌষধ বলতে পার।
এখন তাহলে আয়ুৰ্বেদী চিকিৎসাও চলছে?
যে যা বলছে তাই করছি। একজন হালুয়া ঘাট থেকে পীর সাহেবের পানি পড়া এনে দিলেন–তাও খেলাম।