আবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে কুদ্দুস মাথা ঢুকিয়ে বলল, বড় সাব আফনেরে ডাকে। বিশেষ দরকার।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। মনজুরের ইচ্ছে করছে বলতে-বড় সাহেবকে এইখানে আসতে বল। আমার নড়াচড়ার শক্তি নেই। তা বলা সম্ভব নয়।
নুরুল আফসার এই ভোরেই মদ্যপান করেছেন।
ঘরময় এলকোহল এবং সিগারেটের কটু গন্ধ। এয়ারকুলার চলছে। এয়ারকুলার থেকে পাতলা ধাতব আওয়াজ আসছে যা সূক্ষ্মভাবে মাথার উপর চাপ ফেলে। এক সময় মাথায় যন্ত্রণা হতে শুরু করে।
নুরুল আফসার টেবিলে পা তুলে আধশোয়া হয়ে আছেন। মনজুরের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, তুই আছিস কেমন?
ভালো।
তোকে একটা কমপ্লিমেন্ট দেয়ার জন্যে ডাকিয়েছি।
কী কমপ্লিমেন্ট?
পৃথিবীতে নির্লোভ মানুষ আছে বলে আমার ধারণা ছিল না। তুই প্রমাণ করেছিস যে আছে। তুই কি ছোটবেলা থেকেই এমন, না বড় হয়ে হয়েছিস?
ছোটবেলায় আমি বিরাট চোর ছিলাম।
নুরুল আফসার আগ্রহ নিয়ে তাকালেন। মনজুরের কথায় তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন।
তুই ছোটবেলায় চোর ছিলি?
হুঁ।
কী চুরি করতি?
খালার বিছানার নিচ থেকে ভাংতি পয়সা সরাতাম।
রেগুলার সরাতি?
হুঁ। পরে জানতে পারলাম আমি যাতে পয়সা চুরি করতে পারি সে জন্যেই খালা সব সময় তোশকের নিচে ভাংতি পয়সা রাখতেন; কারণ এমনিতে আমি কখনো টাকা পয়সা নিতাম না। হাজার সাধাসাধিতেও না।
তোর খালাও মনে হচ্ছে তোর মতোই ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।
খালা একজন চমৎকার মানুষ। তোর কথা কি শেষ হয়েছে? আমি এখন ডিভানে শুয়ে খানিকক্ষণ ঘুমাব। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
কথা শেষ হয় নি। আসল কথা, এবং সবচে’ ইম্পটেন্ট কথাটাই বাকি।
যদি সম্ভব হয় তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
নুরুল আফসার টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এই ফার্মটা শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। তুই আমার পাশে দাঁড়িয়ে গাধার মতো খেটেছিস। মনে আছে?
আছে।
তোকে অনেকবার বলছিলাম আমাকে তুই দাঁড় করিয়ে দেন; তোকে আমি ঠকাব না। কি কি মনে আছে?
আছে।
তুই তোর কথা রেখেছিস–আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিস। আমি আমার কথা রাখতে চাই। তুই কি লক্ষ করেছিস পে-স্লিপে তোর নাম নেই?
লক্ষ করেছি।
কেন নেই এ নিয়ে তোর মনে প্রশ্ন ওঠে নি?
উঠলেও খুব মাথা ঘামাই নি।
আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ফিরে আসতে পারি। আবার নাও আসতে পারি। এই ফার্মের মালিকানার একান্ন ভাগ তোকে দিয়ে যাচ্ছি। বাকি উনপঞ্চাশ ভাগ থাকবে আমার। পরিচালনার যাবতীয় ক্ষমতা থাকবে তোর হাতে। তের হাজার মাইল দূর থেকে আমি সুতা নাড়ব না। অনেস্ট।
মনজুর হ্যাঁ-না কিছুই বলল না।
সে খুশি হলো না অখুশি হলো তাও বোঝা গেল না। বড় বড় ঘটনা তার উপর কোনোই প্রভাব ফেলে না। তার চোখ ছোট ছোট। তাকে দেখে মনে হচ্ছে জেগে থাকার জন্যে তাকে কষ্ট করতে হচ্ছে।
নুরুল আফসার বললেন, মনজুর, কোম্পানির এসেটস যেমন আছে–লায়াবিলিটিসও আছে। আমাদের ব্যাংক-লোন আছে দু কোটি টাকার উপর। সব কিছু মাথায় রাখতে হবে। কিছু ডিসঅনেস্ট কর্মচারী আমাদের আছে। ডিসঅনেষ্ট হলেও তারা খুব এফিসিয়েন্ট। এদের কখনো হাতছাড়া করবি না। আবার কখনো এদের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবি না। তুই কি ঘুমিয়ে পড়ছিস নাকি?
না।
তুই তোর ঘরে গিয়ে বস। কাগজপত্র পাঠাচ্ছি। অনেক কাগজে সিগনেচার করতে হবে।
মনজুর তার ঘরে ঢুকল। তার মনে হচ্ছে খবরটা ছড়িয়ে গেছে, অফিসের সবাই এখন জানে। যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেই কেমন অন্যরকম করে তাকাচ্ছে। মনজুরের ঘরে যাবার পথ মূল অফিস ঘরের ভেতর দিয়ে। মূল অফিসে পা দেয়ামাত্র সবার কাজকর্ম থেমে গেল। তাদেরকে কেমন যেন নার্ভাস লাগছে।
মনজুর তার ঘরে ঢুকে ডিভানে গা এলিয়ে দিল। খুব তৃষ্ণা লাগছে। অথচ উঠে পানির বোতলের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।
জাহানারা একগাদা কাগজ হাতে ঢুকেছে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, বড় সাহেব পাঠিয়েছেন–সই করতে হবে স্যার।
কলম আছে তোমার কাছে?
জ্বি আছে।
দস্তখত করতে করতে মনজুর বলল, তুমি কাঁদাছ কেন জাহানারা?
জাহানারা অপ্ৰস্তুত হয়ে গেল। খবরটা শোনার পর থেকে একটু পরপর তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছে না। কী যে আনন্দ হচ্ছে! কেন এত আনন্দ? কেন?
জাহানারা আজ বাড়ি ফেরার পথে কয়েকটা জিনিস কিনল। একটা গ্লাস, সুন্দর একটা চায়ের কাপ, ভালো একটা চিনামাটির প্লেট। জাহানারার মা অবাক হয়ে বললেন, সব জিনিস একটা একটা করে কেন রে মা?
জাহানারা বিব্রত গলায় বলল, আমার কি টাকা আছে? ধীরে ধীরে কিনব। জিনিসগুলো সুন্দর হয়েছে না। মা?
হ্যাঁ সুন্দর। পরে কি তুই সেট মিলিয়ে কিনতে পারবি?
পারব।
জাহানারা মুখে বলল–পারবে, কিন্তু সে ঠিক করে রেখেছে সেট মিলিয়ে সে কিনবে না। এই জিনিসগুলো তার কাছে একটা করেই থাকবে।
দরজার কড়া নড়ছে
দরজার কড়া নড়ছে।
মনজুর বড় বিরক্ত হলো। এত ভোরে কে এল? ইদানীং সবাই মিলে তাকে খুব বিরক্ত করছে। অফিসের লোকজন আসছে–কখনো একা, কখনো দল বেঁধে। একবার এলে আর যেতে চাচ্ছে না। সেদিন করিম সাহেব এলেন, সঙ্গে নীল রঙের একটা বোতল। এই বোতলে হালুয়াঘাটের এক পীর সাহেবের পানি-পড়া আছে। এই বস্তু জোগাড় করতে তাকে যে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে। সে গল্প এক ঘণ্টা ধরে করলেন। গল্প শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এই পানি-পড়া জোগাড় করার চেয়ে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘিনীর কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে আসা অনেক সহজ।