ফরিদ।
জ্বি।
আমি একটা ছেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছিলাম। তুমি কি কিছু শুনতে পেয়েছ?
জ্বি না।
তুমি কি জেগে ছিলে?
জ্বি জেগে ছিলাম। নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না।
তুমি যদি জেগে থেকে কিছু না শুনে থাক তাহলে ধরে নিতে হবে। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি একটা কাজ কর-আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস কর। দেখি বলতে পারি। কিনা। পাগলেরা ধাঁধার উত্তর পারে না।
ফরিদ বলল, আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার বিশ্রাম দরকার।
এখন আমার শরীরটা খুব ভালো লাগছে। বিশ্রামের কোনোই দরকার নেই। এস দুজন বারান্দায় বসে থাকি।
আপনার ঠাণ্ডা লাগবে।
তা লাগবে। লাগুক না। চল–ভোর হওয়া দেখি।
ভোর হতে এখনো অনেক দেরি।
মোটেই দেরি নয় ফরিদ সাহেব। সময় অত্যন্ত দ্রুত যায়। আমরা জীবন শুরু করি, তারপর হঠাৎ একদিন দেখি–সময় শেষ–দুয়ারে পাল্কি এসে দাঁড়িয়েছে।
আজ মীরার নতুন চাকরিতে যোগ দেবার কথা
আজ মীরার নতুন চাকরিতে যোগ দেবার কথা।
জালালউদ্দিন গাড়ি রেখে গেছেন। প্রথম দিন সে গাড়ি করে যাক। মীরা বলেছে গাড়ি লাগবে না। তবু খুশিই হয়েছে। গাড়ি সে ছেড়ে দেবে না। শুরুর দিনটিতে তারা নিশ্চয়ই তাকে সারাদিনের জন্যে রেখে দেবে না। কাজটাজ খানিকটা বুঝিয়ে দিয়ে বলবে–বাসায় চলে যান। প্রথম দিনেই এত কাজের দরকার নেই। সে তখন গাড়ি নিয়ে খুব ঘুরবে। বিশেষ কোথাও যাবে না। এমনি ঘুরবে। গুলশান মার্কেট যেতে পারে। সুন্দর সুন্দর কিছু বিছানার চাদর কেনা যেতে পারে। বিছানার চাদর কেনা মীরার হবি বিশেষ। কত ধরনের চাদর যে তার আছে–তারপরেও কেনা চাই।
কাজের মেয়েটি ঘরে ঢুকে বলল, আফা আপনার কাছে আইছে।
কে এসেছে?
কাজের মেয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসল। যার মানে যে এসেছে তার পরিচয় দিতে লজ্জা লাগছে এবং কিঞ্চিৎ হাসি পাচ্ছে। নিশ্চয়ই মনজুর। মীরা কঠিন গলায় বলল, হাসছ কেন?
হাসি থেমে গেল। কাজের মেয়েটি এখন ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। মীরা এমন কঠিন করে কথা বলবে তা হয়তো সে ভাবে নি। মীরা শীতল গলায় বলল, উনি যদি আসেন কখনো এমন করে হাসবে না, যাও দুকাপ চা দিতে বল।
আটটা চল্লিশ বাজে। এখনো অনেক সময় আছে। দশটা বাজার পনের মিনিট আগে রওনা হলেই হবে। মীরা আয়নার দিকে তাকাল। চুল বাধা হয় নি। এইভাবেই কি যাবে, না চুল বাধবে? শাড়িটাও গুছিয়ে পরা নেই। একটু কি গুছিয়ে পরা উচিত না? সে চিরুনি হাতে নিয়ে দ্রুত চুলের উপর টানতে লাগল।
আশ্চর্য! মীরাকে ঢুকতে দেখে মনজুর উঠে দাঁড়াল। বাইরের একজন মহিলাকে সে যেন সম্মান দেখাচ্ছে। কোনো মানে হয়? মীরা বলল, কেমন আছ?
ভালো।
কী রকম ভালো সেটা শুনি।
মোটামুটি ভালো। চলাফেরা করতে পারছি। কতদিন পারব জানি না।
তোমার হাসপাতালে ভর্তি হবার খবর শুনেছি। সরি, দেখতে যেতে পারি নি। হাসপাতাল আমার ভালো লাগে না। বাবা একবার অসুখ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। দশ দিন ছিলেন। আমি দেখতে যাই নি। হাসপাতালের গন্ধ আমার সহ্য হয় না।
মনজুর হেসে বলল, কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? আমি কি কৈফিয়ত তলব করতে এসেছি?
কী জন্যে এসেছ?
তোমার অনেক জিনিসপত্র আমার কাছে রয়ে গেছে—ঐসব কী করবে তাই জানতে এসেছি।
থাকুক। তোমার ওখানে। এক সময় নিয়ে আসব।
আমি এখন কিছুদিন মেজো মামার সঙ্গে থাকব। তোমার জিনিসপত্র আবার নষ্ট না হয়।
নষ্ট হলে হবে, কী-বা আছে!
মনজুর উঠে দাঁড়াল। মীরা বলল, বাস চা আসছে। তুমি যাবে কোথায়–অফিসে?
হ্যাঁ।
আমি নামিয়ে দেব। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। সাড়ে নটার সময় আমি বের হব। চলবে তো?
চলবে।
কাজের মেয়েটি চা নিয়ে ঢুকেছে। শুধুই দুকাপ চা, সঙ্গে কিছুই নেই। সামান্য ভদ্রতাটুকুও কি এরা এই মানুষটাকে দেখাবে না?
নাও চা খাও। চিনি হয়েছে?
হয়েছে।
আমি এর মধ্যে তোমার খোঁজ নেয়ার জন্য তোমাদের অফিসে টেলিফোন করেছিলাম। তুমি ছিলে না। অফিসের এক ভদ্রলোক বললেন, তুমি আজকাল অফিসে খুব কম আসে। তোমার শরীর কি বেশি খারাপ?
শরীর খুব বেশি খারাপ না। অফিসে যাই না। কারণ মনে হচ্ছে আমার চাকরিটা নেই।
কী বলছ তুমি!
এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না। তবে এদের ভাবভঙ্গিতে তাই মনে হচ্ছে।
তুমি ভালোমতো জানতেও চাও নি?
না।
কেন না–সেটা আমাকে গুছিয়ে বল।
আমার ইচ্ছা করছিল না। যা হবার হবে।
তুমি গা এলিয়ে পড়ে থাকবে?
সব সময় তো তাই করেছি।
এটা কি কোনো বাহাদুরি?
মনজুর কিছু বলল না। মনে হয় একটু হাসল। মীরা রাগী গলায় বলল, তুমি এমনভাবে কথা বলছি যেন গা এলিয়ে পড়ে থাকা খুব অহঙ্কারের ব্যাপার। যেন তুমি মস্ত কাজ করে ফেলাছ।
রেগে যাচ্ছ কেন মীরা?
রাগের কাণ্ড করছ, তাই রেগে যাচ্ছি। এই ফার্ম দাঁড় করাবার পেছনে তোমার কনট্রবিউশন আমি কি জানি না? তুমি কখনো বল নি, তোমার বচস বলেছে। আর সে তোমাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলবে–তুমি কোনো কথা বলবে না?
মনজুর সিগারেট ধরিয়ে বলল, একেকজন মানুষ একেক রকম হয়। আমি ছোটবেলা থেকেই এরকম। কত বড় বড় ঘটনা ঘটে, প্ৰথমে খুব হকচকিয়ে যাই, তারপর মনে হয় আচ্ছা ঠিক আছে। কী আর করা।
তুমি তাহলে একজন সাধুপুরুষ? মহামানব?
আরে কী যে বল! তুমি এতদিন পর আজ হঠাৎ এত রাগ করছ, কেন?
জানি না। তোমাকে দেখে কেন জানি খুব রাগ লাগছে। যাও আর রাগ করব না। তুমি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আরেক কাপ চা খাও। আমি কাপড় বদলে আসি।