কেমন লাগছে?
ভাঙা ভাঙা। মনে হচ্ছে কোনো কারণে খুব কান্নাকাটি করেছেন।
কী যে পাগলের মতে কথা বল! শারমিন খিলখিল করে হাসল। হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আপনাকে লিখেছিলাম কয়েকটা সায়েন্স ফিকশন পাঠাতে, আপনি পাঠিয়েছেন ভূতের উপন্যাস।
স্টিফান কিং পাঠিয়েছি। খুব ভালো লেখা।
ভূতের গল্প পড়ে, শেষে রাতে ভয়ে মারি আর কি! আপনি সায়েন্স ফিকশন পাঠাবেন। এসিমভের নতুন কোনো বই।
ঠিক আছে। আর শোন, তোমাকে যে একটা জিনিস পাঠাতে বলেছিলাম, সেটা তো পাঠালে না।
শারমিন লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
ঐ সব পাঠানো যাবে না।
যাবে না বললে হবে না। পাঠাবে।
শারমিন কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, আজ কিন্তু আমার জন্মদিন।
তাই নাকি? মাই গড, আমার মনেই ছিল না।
তা থাকবে কেন? আচ্ছা, রেখে দিচ্ছি।
না, রাখবে না। অনেক কথা আছে।
শারমিন হাসল।
শাহানার স্যার
শাহানার স্যার এসেছেন। শাহানা অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছে। ভাবীর এসে কাছেই কোথাও বসবার কথা। কিন্তু ভাবী আসছে না। স্যার ভারি গলায় বললেন, এত ছটফট করছ, কেন, কি হয়েছে?
কিছু হয়নি স্যার।
তাহলে মন দিয়ে শোনা কি বলছি। এ কিউব প্লাস বি কিউব…
স্যার, আমি একটু আসছি।
শাহানা উঠে রান্নাঘরে গেল। নীলু ভাত চড়িয়েছে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই ভাত হয়ে যায়, আজ দেরি হচ্ছে। বাসাবো থেকে নীলুর এক খালাশাশুড়ি এসেছিলেন। মাত্র কিছুক্ষণ আগে গেলেন।
ভাবী।
কী ব্যাপার?
একটু এসে বস না ভাবী। স্যার এসেছেন।
ভাত চড়িয়েছি। শাহানা, বাবাকে বল।
বাবা রশীদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন। স্যারকে বলে দিই। আজ পড়বে না?
ঠিক আছে। তোমার যদি পড়তে ইচ্ছা না করে, বলে দাও।
শাহানা দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি এসে বলে দাও না ভাবী।
আমি কেন?
শাহানা ইতস্তত করে তুলল, বলে দাও আমি আর তাঁর কাছে পড়ব না। আজও সে-রকম হয়েছে ভাবী।
ভুলে হয়। সামান্য জিনিসটাকে এত বড়ো করে দেখছ কেন?
শাহানা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ভুলে না ভাবী।
ঠিক আছে। চল, বলব ওনাকে।
আমি যাব না। তুমি এক গিয়ে বলবে।
আর পড়াতে হবে না শুনে মাস্টার সাহেব কিছু বললেন না। নীলুর ধারণা ছিল জিজ্ঞেস করবেন–কেন? কিন্তু তিনি কিছু করলেন না। আপনার পাওনা টাকাটা আপনি সামনের মাসের তিন তারিখে এসে নিয়ে যাবেন।
মাস্টার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
বসুন, চা খেয়ে যান।
মাস্টার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বসলেন। শাহানা নিজেই চা এনে দিল। চায়ের সঙ্গে দেবার মতো কিছু ছিল না। শুধু চা দিতে শাহানার লজ্জা লাগছিল। মাস্টার সাহেব খুব আগ্রহ করে চা খেলেন। মৃদু স্বরে বললেন, যাই শাহানা, মন দিয়ে পড়বে।
শাহানার মন খারাপ হয়ে গেল। এমন এক জন ভাল টিচার, কিন্তু কী বাজে একটা স্বভাব! নিশ্চয়ই আরো অনেক জায়গা থেকে তাঁকে এভাবে বিদায় নিতে হয়েছে।
শাহানার আজ আর বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না। রান্নাঘরে গিয়ে ভাবীর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু এখন সেখানে মা আছেন।
রান্নাঘরে গেলেই মাস্টার চলে গেল কেন সেই প্রশ্ন উঠবে। শাহানার ঠিক এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছা করছে না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল, মা চড়া গলায় চেঁচাচ্ছেন—
মনটা কত ছোট দেখ বৌমা। বাবুর মুখ দেখে দশটা টাকা দিয়ে গেল, তাও ময়লা একটা নোট। হাতে নিলে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হয়।
বাদ দেন মা।
কেন, বাদ দেব কেন? তার নাতনীর মুখ দেখে দেড় শ টাকা খরচ করে আঙটি দিয়েছি। তার ছোট মেয়ের বিয়ের সময় তিন শ টাকা খরচ করে জামদানি দিয়েছি। আমার টাকা কি গাছে ফলে? বল বৌমা, গাছে ফলে?
সবাই টাকা খরচ করতে পারে না, মা।
বাজে কথা বলবে না। খরচ ঠিকই করতে পারে। নিজের বেলায় পারে। পঁচিশ বছর ধরে দেখছি তো। নাড়িনক্ষত্র জানি। যাও বৌমা, ঐ দশ টাকাটা তুমি রাস্তায় ফেলে দিয়ে আস, আমার আলমারির উপর আছে।
বাদ দেন মা।
তোমাকে ফেলতে বলেছি ফেলে দিয়ে আসে। ঐ দশ টাকা নিয়ে আমি স্বগে যাব না।
নীলু বেরিয়ে আসতেই শাহানা ফিসফিস করে বলল, আমাকে দিয়ে দিও ভাবী।
এস, নিয়ে যাও। আর একটু বাবুর কাছে গিয়ে বস, এক্ষুণি দুধ খাবার জন্যে কাঁদবে।
বাবুর পাশে শফিক বসে ছিল। গভীর মনযোগে সে ফাইল দেখছে। আজ সারাটা দিন তার নষ্ট হয়েছে। হিসাবে কোথাও জট পাকিয়ে গেছে। হিসাবপত্র দেখার দায়িত্ব মণীন্দ্রনাথের। সে ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে।
ভাইয়া, আসব ভেতরে?
আয়।
কী করছ?
একটা ফাইল দেখছি।
বসি একটু?
শফিক অবাক হয়ে বলল, বোস। জিজ্ঞেস করছিস কেন?
তোমাকে কেমন জানি ভয়-ভয় লাগে ভাইয়া। সারাক্ষণ এমন গম্ভীর হয়ে থাক।
শফিক হাসল।
অফিসে সবাই নিশ্চয়ই তোমাকে ভয় পায়। পায় না?
পায় বোধহয়। জানি না।
তুমি মাস্টার হলে ছাত্রদের অবস্থা কাহিল হয়ে যেত ভাইয়া।
শফিক ফাইলে মন দিল। হিসাবের জটটা না-খুললে কিছুতেই আর মন বসবে না। মণীন্দ্র মহা ঝামেলা লাগিয়ে রেখে গেছে।
ভাইয়া, একটা কথা শোন।
পরে শুনব। কাজটা শেষ করে নিই।
কথা না-বলে চুপচাপ বসে থাকা মুশকিল। শাহানা উশখুশ করতে লাগল।
কাজ শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে ভাইয়া?
শফিক, জবাব দিল না। শাহানা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
রান্না শেষ হতে রাত নটা বাজল। নীলু এসে বলল, শাহানা, চট করে যাও তো, আনিসকে বলে আসা খাবার দেওয়া হয়েছে।
শাহানা অবাক হয়ে তাকাল।
আমি আজ রাতে ওকে খেতে বলেছি।
কেন ভাবী?
এমনি বলেছি। খেতে বলার জন্যে আবার বিরাট কোনো কারণ লাগবে নাকি? যাও, বলে আস।