ক্লাশের সব ছেলের হৈহৈ করে তাকে খুব সাপোর্ট দিল। কাজের সময় সবাই পিছিয়ে গেল। শুধু রফিককে দেখা গেল মেয়েদের মাঝখানে বইখাতা নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। স্যার অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার, তুমি এদের মধ্যে কেন? ক্লাসে দারুণ হাসিাহসি শুরু হয়ে গেল। স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, যাও যাও, নিজের জায়গায় গিয়ে বস। সবার চেষ্টা কীভাবে মেয়েদের বিরক্ত করা যায়। এটা ভালো না। মেয়েদের দিকে মন দেবার সময় অনেক পাবে, এখন পড়াশোনার দিকে মন দাও। আবার হাসির ঝড় উঠল।
আবার এক দিন সে ডায়াসে উঠে গম্ভীর গলায় এক বক্তৃতা দিয়ে বসল, আমরা ছেলেদের তুই তুই করে বলি অথচ মেয়েদের বলি আপনি করে। আজ এই বারই সেপ্টেম্বরের সকালবেলা আমি ঘোষণা করছি এখন থেকে আমরা মেয়েদেরও তুই করে বলব।
ক্লাসে নাসরিন হচ্ছে সবচে গম্ভীর ধরনের মেয়ে। মেয়ে না বলে বলা উচিত মহিলা। দুটি বাচ্চা আছে তার। রফিক নাসরিনের কাছে গিয়ে বলল, নাসরিন, তুই কেমন আছিস? নাসরিন রেগেমেগে অস্থির। চোখ-মুখ লাল করে বলল, আমার সঙ্গে ফাজলামি করবেন না। মেয়েদের তুই ডাকার ব্যাপারে এখানেই চাপা পড়ে গেল। এক ধমকেই উৎসাহ মিইয়ে গেল রফিকের। কত বিচিত্র ধরনের মানুষই না আছে!
শারমিন অলস ভঙ্গিতে বাড়ির পেছনের দিকে রওনা হল। সেখানে তিনটা বড়ো বরই গাছ আছে। রোদের মধ্যে হাঁটতে ভালো লাগছে। বিশাল এ্যালসেশিয়ানটি আসছে তার পেছনে পেছনে। শারমিন তার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যালো মাটি সাহেব? কুকুরটি লেজ নাড়াল। চমৎকার একটি সকাল, কি বল মাটি? মাটি মাথা নাড়াল। যেন সে শারমিনের কথার অর্থ বুঝতে পারছে। চমৎকার একটি সকালে সম্পূৰ্ণ অকারণে মাঝে মাঝে মানুষদের মন খারাপ হয়। তাদের কিছুই ভালো লাগে না। তোমাদেরও কি সে-রকম হয়?
মাটি সাহেব লেজ নাড়ােল। যার কোনো অর্থ বোঝা গেল না। কুল গাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকলে কেমন হয়? শারমিন তাই করল। মাটি সাহেবের বসে থাকার পরিকল্পনাটা মনে ধরল না। সে রওনা হল গেটের দিকে।
গাছ ঝেঁপে কুল হয়েছে। পাকা কুলের গন্ধে মম করছে চারদিক। খাবার লোক নেই। প্রকাণ্ড এই বাড়িতে তারা দুটিমাত্র মানুষ—সে এবং বাবা। চার-পাঁচ জন কাজের মানুষ আছে, ড্রাইভার এবং দারোয়ান আছে, কিন্তু ওদের থাকার জায়গা ভিন্ন। গেটের কাছে তাদের জন্যে বড় একটা ঘর তৈরি আছে।
সব কিছুই মানুষের অভ্যেস হয়ে যায়। এই বিরাট বাড়িতে কত দীর্ঘ দিন ধরেই তারা দু জন থাকছে। খুব ছোটবেলায় সে ঘুমোত। বাবার সঙ্গে। কোনো কোনো রাতে ভয়ানক সব স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে কাঁদত। বাবা বলতেন, এই তো আমি, তোমার হাত ধরে আছি। কোনো ভয় নেই। স্বপ্ন দেখেছ?
হুঁ।
কী স্বপ্ন? ভূতের স্বপ্ন। দূর বোকা মেয়ে, ভূত আছে নাকি পৃথিবীতে? ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই।
বাতি জ্বালিয়ে রাখ, বাবা।
বাবা বাতি জ্বলিয়ে দিতেন।
বাথরুম করব।
তিনি তাকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেতেন।
শারমিনের প্রায়ই মনে হয়। পৃথিবীর কোনো বাবা বোধহয় তার বাবার মতো নয়। কোনো বাবা তাঁর মেয়েকে এতটা ভালোবাসেন না। সেই কবে শারমিনের মা মারা গেলেন। বাবা তখন যুবক মানুষ, সাতাশ-আঠশ বছর বয়স। কিন্তু মেয়ের কষ্ট হবে এই ভেবে দ্বিতীয় বার বিয়ে করলেন না।
তাঁর অর্থ বিত্ত কোনো কিছুর অভাব ছিল না। ইচ্ছা করলেই তিনি মেয়ের দেখাশোনার জন্যে কয়েক ডজন কাজের লোক রাখতে পারতেন। তাও তিনি করেন নি। মেয়ের প্রতিটি প্রয়োজন নিজে মেটাতে চেষ্টা করেছেন।
রোজ নিজে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। ক্লাস শেষ হলে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতেন। ম্যাটিক ক্লাস পর্যন্ত সন্ধ্যার পর পড়া দেখিয়ে দিয়েছেন। মায়ের তালোবাসার অভাব তিনি একা মেটাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু অভাব আছে, যা কিছুতেই বোধহয় মেটে না। চাপা পড়ে থাকে শুধু।
আফামনি! আপনের টেলিফোন।
কে করেছে?
বড়ো সার।
শারমিন উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরল।
কি করছিলে মা-মনি?
কিছু না। কুল গাছের নিচে বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম।
বন্ধুবান্ধব কাউকে আসতে বলেছ?
না বাবা। আমরা দুজনেই জন্মদিন করব। তুমি কখন আসবে?
সাতটার মধ্যে এসে পড়ব। খুব বেশি দেরি হলে সাড়ে সাত।
না, এত দেরি করলে চলবে না। তোমাকে আসতে হবে ছটার মধ্যে। পজিটিভলি?
আজ রাতে কি আমরা বাইরে খাচ্ছি?
না, ঘরেই খাবে। আমি রান্না করব বাবা।
চমৎকার! কী রান্না হচ্ছে?
তা বলব না। একটা সারপ্রাইজ আছে।
খাওয়া যাবে তো মা?
যাবে। যাবেনা কেন?
রহমান সাহেব হাসতে লাগলেন। শারমিন বলল, তুমি কিন্তু ছটার মধ্যে আসবে।
হ্যাঁ, আসব। আর শোন মা, আমেরিকায় একটি কল বুক করে সাব্বিরের সঙ্গে কথা বল।
শারমিন লজ্জিত স্বরে বলল, কেন?
জন্মদিন উপলক্ষে কথা বলা!
সে তো উনি আমাকে করবেন। আমি কেন করব?
তাও তো ঠিক। তুমি আসছতো বাবা সন্ধ্যা ছাঁটার মধ্যে?
হ্যাঁ।
আমি কিন্তু পাঁচটার সময় আবার তোমাকে টেলিফোন করব। মনে করিয়ে দেবার জন্যে।
ঠিক আছে, মনে করিয়ে দিও।
শারমিন টেলিফোন রেখে দিল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকায় একটা কল বুক করল। সেখানে এখন বাজে রাত বারটা। সাব্বিরকে পাওয়া যাবার কথা। শারমিন একবার ভাবল নিজের পরিচয় না দিয়ে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বললে কেমন হয়।
হ্যালো। কে?
গলা শুনে বুঝতে পারছেন না কে?
ও, শারমিন, কী ব্যাপার?
কোনো ব্যাপার নেই। আপনার গলা এমন লাগছে কেন?