তাকে অবাক করে দরজা খুলল শারমিন। শারমিনকে আজ অন্য দিনের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। নিজের বাড়িতে আছে বলেই হয়তো চেহারায় কোনো কাঠিন্য নেই। চুল বাঁধা নয়। পিঠময় ছড়ানো। সাধারণ একটা সুতির শাড়ি এলোমেলো করে পরা। রফিক বলল, চিনতে পারছেন তো?
চিনতে পারব না কেন? আসুন, ভেতরে আসুন।
রফিক হড়বড় করে বলল, আগামসি লেনে এসেছিলাম একটা কাজে। তারপর ভাবলাম। এত কাছে যখন এসেছি, তখন বরং দেখেই যাই।
ভালো করেছেন। আমি যে এখানে থাকি, সেটা জানলেন কীভাবে?
রফিক জবাব দিল না। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। বসার ঘরটা তেমন জমকাল নয়, বরং বলা চলে বেশ সাধারণ। বেতের তিনটি সোফা। পাশে ছোট ছোট কফি টেবিল। কার্পেটটিও বিবর্ণ। বাড়ির সঙ্গে খাপ খায় না। শারমিন হাসিমুখে বলল, এত মন দিয়ে কী দেখছেন?
আপনাদের বসবার ঘরটা আরো জমকাল হবে ভেবেছিলাম।
এটা ড্রইং রুম না। এটা হচ্ছে এস্ট্রি রুম। বসবার ঘরে ঢোকবার আগের ঘর।
বলেন কি!
ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। ওদের মতো করে বানানো হয়েছে। এমন কি বসবার ঘরে একটা ফায়ার প্লেস পর্যন্ত আছে।
মাই গড!
আসুন, আপনাকে দেখাই।
বসবার ঘরে ঢুকে রফিকের মন খারাপ হয়ে গেল। কোনো এক জন মানুষের এত বেশি টাকা থাকবে এবং অন্য এক জনের পকেটে থাকবে দুটি পাঁচ টাকার নোট, যার একটি ছেঁড়া বলে চালানো যাচ্ছে না।
শারমিন বলল, এবার পছন্দ হয়েছে বসবার ঘর?
তাহলে মুখ এমন গম্ভীর করে আছেন কেন? ক্লাসে তো আপনার কথার যন্ত্রণাতে সবাই অস্থির!
রফিকে ফ্যাকাসেভাবে হাসল।
বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
রফিক বসল। বসতে বসতে বলল, আপনারা এতটা বড়োলোক, আমি বুঝতে পারিনি।
বুঝতে পারলে আসতেন না?
রফিক সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আপনার এখানে সিগারেট খাওয়া যাবে?
যাবে না কেন, এটা তো আর মসজিদ না। খান। তারপর বলুন কোনো কাজে এসেছেন, না এমনিতেই এসেছেন?
শারমিনের মুখ হাসি—হাসি। রফিক বেশ অবাক হল। এই মেয়েটি ক্লাসে প্রায় কোনো কথাই বলে না। ছেলেরা কেউ কাছে গেলে চোখ-মুখ কঠিন করে রাখে। অথচ এখন কেমন সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছে। আরেকটি জিনিস দেখেও রফিক অবাক হল, শারমিনের পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল। সাত-আট টাকায় যে-সব পাওয়া যায়, সে-সব। তার ধারণা, এ-রকম বাড়িতে যারা থাকে, তারা ঘরে সাধারণত জয়পুরী ঘাসের স্যাণ্ডেল পরে। কি শারমিন বলল, চুপ করে আছেন কেন? বলুন, কোনো কাজে এসেছেন কি?
না, কোনো কাজে আসি নি।
গল্প করবার জন্যে এসেছেন?
হ্যাঁ।
বেশ, গল্প করুন, এমন স্টিফ হয়ে আছেন কেন? আমার মনে হয় এই ড়ুইং রুমটায় আপনি ঠিক ইজি ফিল করছেন না। আমার নিজের একটি বসার ঘর আছে, আমি আমার নিজের মতো করে সাজিয়েছি। চলুন, ওখানে বসি। এই ঘরটা আমার নিজেরো ভালো লাগে না, কেমন যেন স্টাফি মনে হয়।
শারামিনের নিজের বসবার ঘরে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে ট্রলিতে করে একটি কাজের মেয়ে চা নিয়ে এল। চমৎকার একটি রূপোর থালায় ফুট কেক। অন্য একটি প্লেটে শিউলি ফুলের মতো ধবধবে সাদা সন্দেশ।
এই সন্দেশ ঘরে তৈরী। আমাদের রমিজ ভাইয়ের করা, এক বারু খেলে সারা জীবন মনে থাকবে। এর একটি নাম আছে। নামটি আমার দেয়া–গোলাপ বাহার। সন্দেশে গোলাপের গন্ধ আছে।
খাবার জিনিসে ফুলের গন্ধ আমার ভালো লাগে না। ফুলের গন্ধ থাকবে ফুলে। সন্দেশে থাকবে সন্দেশের গন্ধ।
শারমিন খিলখিল করে হেসে উঠল। এত সুন্দর হয় মানুষের হার্সি! রফিক তাকিয়ে রইল মুগ্ধ চোখে।
আপনি খুব ভালো দিনে এসেছেন। আজ আমার জন্মদিন! এই কেক অবশ্যি জন্মদিনের কেক না। জন্মদিনের কেক বাবা সন্ধ্যাবেলা নিয়ে আসবেন। আপনি নিশ্চয়ই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন?
না, আমি এখন উঠব।
রফিক উঠে দাঁড়াল।
এখনই উঠবেন কি! চা তো শেষ করেন নি।
অনেক দূর যেতে হবে।
কত দূর?
আমরা থাকি কল্যাণপুর। শহরের বাইরে।
শারমিন মুখ টিপে বলল, ফার ফ্রম দি মেডিং ক্রাউড?
না, সে-রকম কিছু না। ঐদিকে বাড়িভাড়া কম। আচ্ছা, যাই তাহলে?
এক মিনিট দাঁড়ান। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, আপনাকে পৌঁছে দেবে।
পৌঁছে দিতে হবেনা।
দাঁড়ান তো। এ-রকম করছেন কেন?
রফিককে পৌঁছে দেবার জন্যে চমৎকার একটি লাল রঙের গাড়ি বের হল। রফিক বিব্রত বোধ করতে লাগল।
শারমিন হাসিমুখে বলল, আবার যদি কখনো আপনার বন্ধুর বাড়িতে আসেন, তাহলে এদিকে আসতে পারেন। আমি খুশিই হব। কেউ কখনো আসে না।
আসে না কেন?
খুব যাদের টাকা পয়সা আছে, তাদের কেউ পছন্দ করে না। আমার বন্ধুবান্ধবরা এক বার এসে দ্বিতীয় বার আসতে চায় না। আজ আমার জন্মদিন, অথচ কাউকে আমি আসতে বলি নি। আপনি হঠাৎ করে এলেন।
রফিক ইতস্তত করে বলল, আপনার জন্যে একটা বই এনেছিলাম।
শারমিন অবাক হয়ে বলল, আমার জন্যে! কেন?
রফিক জবাব দিতে পারল না। পলিথিনের ব্যাগে মোড়া বইটি এগিয়ে দিল।
একটা কবিতার বই–এই বসন্তে। সবচে অবাক কাণ্ড হচ্ছে, বইটিতে লেখা—শারমিনের জন্মদিনে। তার মানে, জন্মদিনের কথাটা রফিক জানত। রফিক বলল, যাই শারমিন।
শারমিন কিছু বলল না। সে বড়োই অবাক হয়েছে এবং তার কেমন যেন লজ্জা লজ্জাও করছে। কোথায় যেন সূক্ষ্মতাবে মন খারাপ হবার মতো একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
এই ছেলেটিকে সে পছন্দ করে। দারুণ হুজুগে ছেলে। সারাক্ষণই একটা-না–একটা হৈচৈ নিয়ে আছে। গত মাসে সে হঠাৎ ঘোষণা করল-এটা হচ্ছে সাম্যের যুগ। কবি নজরুলের ভাষায় পুরুষ-রমণীতে কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু এই আমাদের ক্লাসেই ব্যাপারটা উল্টো। এ ক্লাসের সব কয়টা মেয়ে প্রথম দিকের দুসারি চেয়ারে এসে বসবে। এই দুসারি ওদের জন্য রিজাৰ্ভড। এখন থেকে এটা বাতিল। মেয়েদের জন্যে এখন আর আলাদা জায়গা থাকবে না। যে আগে আসবে, সে আগে বসবে।