বড্ড বেশি ক্রাইং হচ্ছে। হোয়াট হ্যাপেণ্ড? দেখি, আমার কোলে দাও তো ভাবী। এক মিনিটের মধ্যে কুল ডাউন করে দিচ্ছি।
মনোয়ারা ধমকে ওঠেন, ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। যা এখান থেকে।
আমি অসুবিধা কী করলাম? এ রকম শকুন চক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
কান্না যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করে থেমে যায়। বাবু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে শুরু করে। কে বলবে এই কয়েক মিনিট আগেই সে রীতিমতো একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল।
রফিক হাই তুলে বলে, কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে, এখন ঘুমানো মুশকিল হবে। এক কাপ চা খেলে মন্দ হত না। কি বল ভাবী?
নীলু জবাব দেয় না। হোসেন সাহেব ক্ষীণস্বরে রফিককে সমর্থন করেন।
দুধ চিনি ছাড়া হালকা লিকারের এক কাপ চা খাওয়া যায়। আইডিয়াটা খারাপ না।
মনোয়ারা রাগী গলায় বলেন, ঘুমুতে আসা। রাত দুটোর সময় চা বানাতে হবে? মাথাটা খারাপ হয়েছে নাকি?
হোসেন সাহেব ঘুমুতে যান। নীলু। সত্যি সত্যি, রাত দুটোর সময় চা বানাতে যায়। চারদিকে শুনশান নীরবতা। গ্যাসের চুলার নীল আগুন জ্বলছে। বিজবিজ শব্দ হচ্ছে কেতলিতে। কেন জানি অন্য রকম একটা ভাব আসে নীলুর মনে। অন্য এক ধরনের আনন্দ। পৃথিবীটাকে বড়ো সুন্দর মনে হয়। ছোটখাট দুঃখ তো থাকবেই, তবু সব কিছু ছাড়িয়ে আমাদের চারদিকে গভীর একটা আনন্দ আছে। এটা যে আছে, তা সব সময় ধরা পড়ে না। কিছু রহস্যময় মুহূর্তেই শুধু ধরা পড়ে।
গাঢ় আনন্দে নীলুর চোখ ভিজে ওঠে। সে গায়ের চাদর দিয়ে চোখ মোছে। রফিক চায়ের তাগাদা দিতে এসে দৃশ্যটি দেখে থমকে দাঁড়ায়।
কাঁদছ কেন ভাবী?
কাঁদছি না।
রফিক ইতস্তত করে বলল, এ বাড়ির আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালবাসি, এই কথাটা কি তুমি জান?
জানি।
এর পরও যদি দুপুর রাতে একা একা কাঁদ, তাহলে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। আর কাঁদবে না।
নীলু হাসল।
তুমি যদি চাও তাহলে একটা খুব মজার গল্প বলে তোমাকে হাসাবার চেষ্টা করতে পারি।
রফিক কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে মৃদুস্বরে বলল, কাল ভোরে তুমি আমাকে এক শটা টাকা দিতে পোর? ধারা। আমি দুই সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দেব। অনেষ্ট।
এইটা তোমার মজার গল্প?
মজার গল্পটা একটু পরে বলছি। আগে সমস্যার কথাটা বলে নিই। ভাবী, পারবো?
এক শ পারব না। পঞ্চাশ দিলে হয়?
বাকি পঞ্চাশ পাব কোথায়?
খুব যদি দরকার হয়, তাহলে তোমার ভাইকে বলে দেখতে পারি। বলব?
বল। তবে ভাবী, আমার কথা বলতে পারবে না। বলবে, তোমার নিজের দরকার।
ঠিক আছে, বলব! এখন শোনাও তোমার হাসির গল্প।
তারা দু জন চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে এসে বসল। রফিক তার নতুন গজানো দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে গল্প শুরু করল:
এক লোক মসজিদে গেছে নামাজ পড়তে। বদনায় পানি বেশি ছিল না, কাজেই একটি মাত্র পা ধোয়া গেল।
নামাজ যখন শুরু হল তখন দেখা গেল ঐ লোক বকের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। অন্য পা-টি গুটিয়ে রেখেছে। তখন ইমাম…
এই পর্যন্ত শুনেই নীলু মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। রফিক বিবক্ত স্বরে বলল, গল্প না-শুনেই হাসছ যে। সবটা শুনে নাও। মেয়েছেলেদের সাথে হাসির গল্প বলাও একটা মুসিবত। না শুনেই হাসি। হোয়াট ইজ দিস?
পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জির মধ্যে
পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জির মধ্যে যে এমন একটি বিশাল এবং আধুনিক ধরনের বাড়ি থাকতে পারে, সেটা রফিকের কল্পনাতেও আসে নি। সে গেটের ভেতরে পা দেবে কি দেবে না, বুঝতে পারল না। এ জাতীয় বাড়িতে কুকুর থাকবেই। এসব কুকুররা আবার কোনো একটা বিশেষ ইন্দ্ৰিয়ের কারণেই বোধহয় মানুষদের মধ্যে যে শ্রেণীর একটা ব্যাপার আছে, সেটা চমৎকার বুঝে ফেলে। কোনো আগন্তুক তাদের মুনিবের শ্রেণীর চেয়ে নিম্ন শ্রেণীর হলেই কামড়াবার জন্যে ছুটে আসে।
বাড়ির গেট বন্ধ। তবে গেটের ভেতরও আবার ছোট গেট আছে, মাথা নিচু করে যার ভেতর দিয়ে ঢুকতে হয়। রফিক তাই করল এবং আশ্চর্য, সত্যি সত্যি একটি কুকুরের ডাক শোনা গেল! ভয়াবহ কিছু নয়, মৃদু গর্জন। রফিক চট করে মাথাটা টেনে নিল। মৃদু। গেটের দারোয়ান বলল, ও কিছু করবে না। আসেন। কাকে চান? বড়োলোকের বাড়িতে ঢোকার এই আরেক ফ্যাকড়া-জায়গায়জায়গায় জবাবদিহি করে ঢুকতে হবে। গেটে একবার বলতে হবে। বাড়িতে বেল টিপলে দ্বিতীয় এক ব্যক্তি আসবে, তাকেও বলতে হবে। তারপর তাকে বসানো হবে, এবং দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হবে। বড়োলোকেরা চট করে দেখা দেন না।
কার কাছে যাবেন?
এই দারোয়ানটির বাড়ি বোধহয় রাজশাহী-টাজশাহীর দিকে হবে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। চেহারাও মাই ডিয়ার টাইপের। রফিক হাসিমুখে বলল, রহমান সাহেব কি আছেন?
জ্বি-না, উনি নাই। সন্ধ্যার আগে ফিরবেন না।
তাঁর মেয়ে কি আছে?
জ্বি, আপামনি আছেন। যান, সোজা চলে যান। দরজার বা দিকে কলিং বেল আছে। কুকুর কিছু করবে না।
রফিক খুব সহজ ভঙ্গিতে হাঁটবার চেষ্টা করল। কিন্তু কুকুরটা আসছে সঙ্গে সঙ্গে। বিশাল পর্বতের মতো একটা জন্তু। তার চোখে গভীর সন্দেহ। বোধহয় টের পেয়ে ফেলেছে, এই লোক তাদের সমাজের না। এবং এই লোকের পকেটে আছে মাত্র দুটি পাঁচ টাকার নোট, যার একটি ছেঁড়া বলে কেউ নিতে চাচ্ছে না। গত এক সপ্তাহে কয়েক বার ভিড়ের মধ্যে বাস কনডাকটারের হাতে গছিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজ হয় নি।
রফিক বেল টিপে দাঁড়িয়ে রইল। কুকুরটা বড়ো বিরক্ত করছে। তাকে শুকে শুকে দেখছে। সে বহু কষ্টে কুকুরটার পেটে প্রচণ্ড একটা কিক দেবার ইচ্ছা দমন করল। কলিং বেল নষ্ট কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কারোর কোনো সাড়া নেই। রফিক দ্বিতীয় বার বেল টিপল।