খুব সিরিয়াস নাকি?
রফিক জবাব না দিয়ে উঠে পড়ে। ভাইয়ে ভাইয়ে এমন অমিল হয় কী করে, নীলু। প্রায়ই ভাবে। শফিকের সঙ্গে রফিকের কোনো মিল নেই। শফিক উত্তর মেরু হলে রফিক দক্ষিণ মেরু।
শফিকের চরিত্রে হালকা কোনো ব্যাপারই নেই। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠবে। কনকনে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল সারবে। নাশতা খেয়ে অফিসের জন্যে তৈরি হবে। এক ফাঁকে শুধু বলবে-নীলু দেখ তো পত্রিকা এসেছে নাকি। সকালবেলা কথাবার্তা এই পর্যন্তই। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যাঁ হাঁ ছাড়া অন্য কোনো জবাব দেবে না।
পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারগুলি সে শুনবে খুব মন দিয়ে। কখনোই কোনো প্রশ্ন করবে না। সমস্যার সমাধান করবে এক লাইনে। নীলু। প্রথম দিকে বলত, কথা কম বল কেন? কথা বলতে কি তোমার কষ্ট হয়? শফিক বলত, না, কষ্ট হয় না।
তাহলে? দিন-রাত মুখ বন্ধ করে থাক কী ভাবে?
অন্যের কথা শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
এটাও সত্যি নয়। সবাই মিলে হয়তো কথাবার্তা বলছে, হঠাৎ দেখা যাবে শফিক নিঃশব্দে উঠে চলে গেছে। যেন কোথাও তার কোনো ভূমিকা নেই।
ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে, এই নিয়েও তার তেমন কোনো উৎসাহ নেই। শাহানা একবার বলল, ভাইয়া, তুমি তো কখনো বাবুকে কোলে নাও না। সে হেসে বলেছে, ছোট বাচ্চা, ঘাড় শক্ত হয় নি, এই জন্যেই নিই না। একটু বড়ো হোক।–বড়োসড়ো হলে দেখবি, কোল থেকে আর নামাব না। নীলুর প্রায়ই মনে হয় শফিকের ভেতর মায়া-মমতাটা বোধহয় একটু কম। একটু না, হয়তো অনেকটাই কম। নীলুর যখন এবোেরশন হল, কী ভয়াবহ অবস্থা। হাসপাতালেই কাটাতে হল। পনের দিনের মতো। এই পনের দিনে শফিক তাকে দেখতে গেল মাত্র তিন দিন। যেন বাইরের কোনো অল্প পরিচিতি আত্মীয় তাকে দেখতে গিয়েছে। চার-পাঁচ মিনিট বসেই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছে, যাই নীলু?
নীলুর চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। সে কিছু বলল না। চোখের পানি গোপন করবার জন্যে অন্য দিকে তাকাল। শাহানা অবাক হয়ে বলল, এখনই যাবে কি ভাইয়া, এইমাত্র তো এলে!
বসে থেকে করব কী?
ভাবীর সঙ্গে গল্প কর।
শফিক অবাক হয়ে বলেছে, কী গল্প করব?
মানুষ এমন অদ্ভূত হয় কেন? প্রায় পাঁচ বছর হয়েছে তাদের বিয়ের। এই দীর্ঘ দিনে এক বারও সে বলে নি-নীলু, এই নাও তোমার জন্যে একটা শাড়ি কিনলাম।
এই যে সংসারে নতুন একটি বাবু এসেছে—সবার মধ্যে কত আনন্দ, কত উত্তেজনা, অথচ শফিক নিবিকার। রাতের খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে ঘণ্টাখানিক বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকবে, তারপর অত্যন্ত সহজভাবে ঘুমুতে যাবে। নীলু। মাঝে মাঝে কথাবার্তা চালাবার চেষ্টা করে।
বাবুর জন্যে কোনো নামটাম ভেবেছ?
তোমরাই ঠিক কর একটা।
বাবা টুনি রাখতে চান। টুনি কেমন লাগে তোমার?
ভালোই তো। টুনিই রাখ।
মার টুনি নাম একেবারেই পছন্দ না। বাবার সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর লেগে যাচ্ছে।
শফিক হাই তুলে বলে, সামান্য একটা নাম নিয়ে এত ঝামেলা কেন?
নামটাকে এত সামান্য ভাবছ কেন? সারা জীবন এটা থাকবে। এক জীবনে কত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে এই নামে ডাকবে। নামটা তো একটা গুরুত্বপুর্ণ জিনিস। ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। তুমি মাঝে মাঝে খুব গুছিয়ে কথা বল।
নীলুর আরো কত কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু শফিকের নিঃশ্বাস অল্প সময়ের মধ্যেই ভারি হয়ে ওঠে।
সে ইদানীং খুব পরিশ্রম করছে। জয়দেবপুরে তাদের নাকি কি কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। রোজ তিনটার সময় মতিঝিল থেকে চলে যেতে হয় জয়দেবপুরে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নটা-দশটা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় যেতে-না-যেতেই ঘুম।
নীলুর ঘুম কমে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকে। ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের বান্ধ জ্বলে সারা রাত। নামেই জিরো পাওয়ার, আসলে বেশ আলো। স্পষ্ট সবকিছু দেখা যায়! সে প্রায়ই চুপচাপ বসে বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত ভালো লাগে তাকিয়ে থাকতে; লাল কম্বলের ফাঁকে টুকটুকে ফর্স একটা মুখ। ভাগ্যিস মেয়েটি তার মতো কালো হয় নি। ওর চাচার রং পেয়েছে। নীলুর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে সারা রাত বাবুকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে। সে তার মেয়ের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথাবার্তাও বলে, কি হয়েছে সোনামনি। ওমা ওমা, ঠোঁট বাঁকা করছে কেন আবার, স্বপ্ন দেখছি মা? ভয়ের স্বপ্ন? দূর বোকা মেয়ে, এই তো আমি পাশে। এই তো তোমার হাত ধরে বসে আছি।
উষ্ণ একটি শয্যা। এক পাশে মা, অন্য পাশে বাবা, তবু ছোট বাবু মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে বা অন্য কোনো কারণে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে। সে কান্না সহজে থামে না।
মনোয়ারা উঠে দরজায় ধাক্কা দেন, কী হয়েছে, এই বৌমা?
কিছু না মা, এমনি কাঁদছে।
আহ্ দরজাটা খোল না। দেখি কী ব্যাপার।
শফিক ঘুম-ঘুম চোখে দরজা খুলে দেয়। মনোয়ারা বিরক্ত স্বরে বলেন, নিশ্চয়ই পিঁপড়া কামড়েছে। কত বার বলি-শোবার সময় বিছানার চাদর ভালো করে ঝাড়বে। কোনো একটা কাজও ঠিকমতো করতে পার না কেন?
পিঁপড়া খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু দুটি মশা পাওয়া যায়। রক্ত খেয়ে লাল হয়ে আছে।
বৌমা, শোবার আগে মশারিটাও দেখে নিতে পার না?
বাচ্চা কাঁদতেই থাকে। হোসেন সাহেব টর্চ হাতে উপস্থিত হন। গম্ভীর গলায় বলেন, পেট ব্যথা। পেট ব্যথার কান্না এ-রকম থেমে থেমে হয়। এক ডোজ আর্নিকা টু হানড্রেড খেলে আরাম হবে।
মনোয়ারা চোখ লাল করে তাকাতেই তিনি চুপ করে যান। চটি ফটফট করতে করতে রফিক এসে উপস্থিত হয়।