বাবুর এখনো নাম ঠিক হয় নি। যখন যার যা ইচ্ছা তাই ডাকে।
একমাত্র হোসেন সাহেব প্রথম দিন থেকে টুনি ডেকে আসছেন।
এই নাম মনোয়ারার মোটেই পছন্দ নয়। প্রথম দিনেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছেন, কী টুনি টুনি করছ? টুনি একটা নাম নাকি?
টুনি নামটা খারাপ কি?
টুনি নামের ছেলেপুলেরা বড়ো হয় না। টুনটুনি পাখির মতো ছোট থাকে।
মানুষের বাচ্চা বড়ো হয়ে মানুষের মতোই হবে; কারো নাম হাতি রাখলেই সে হাতির মতো হবে নাকি?
বাজে তর্ক করবে না।
বাজে তর্ক কী করলাম?
আমার সামনে তুমি টুনি ডাকবে না, ব্যস। যদি ডাকতে ইচ্ছা হয় আড়ালে ডাকবে।
হোসেন সাহেব প্ৰায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্ত্রীর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন। এই একটি ক্ষেত্রে করেন নি। দিনের মধ্যে বেশ কয়েক বার তিনি বেশ উঁচুস্বরেই ডাকবেন!——টুনি, টুনি! ব্যাপারটা উদ্দেশ্যমূলক। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে একটা চাল চালছেন। নিজের পছন্দের নামটি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। তাঁর সাধনা যে পূরোপুরি বিফলে যাচ্ছে, সেটা বলা ঠিক হবে না। তিনি ছাড়াও এ বাড়ির লোকজনও এক-আধা বার মনের ভুলে টুনি বলে ফেলছে। মনোয়ারা নিজেই একদিন বলেছেন।
হোসেন সাহেবের ধারণা, এ-রকম ভুল এরা করতেই থাকবে এবং একসময় টুনি নামটিই স্থায়ী হবে।
হোসেন সাহেব নিচু গলায় বললেন, দেখতে কার মতো হয়েছে বৌমা?
বুঝতে পারছিনা তো। সবাই বলছে। ওর বাবার মতোই হয়েছে।
শফিকের মতো হয়েছে? আরে না। শফিকের সাথে কোনো মিল নেই। তোমার সাথে কিছু মিল আছে। গায়ের রঙটা পেয়েছে তোমার শাশুড়ির। একেবারে গোলাপের মতো রঙ।
নীলু হাসি গোপন করবার জন্যে মুখ অন্য দিকে ফেরাল। সে বুড়ো মানুষটির এই দুর্বলতাটা খুব ভালো জানে, ফাঁক পেলেই তিনি স্ত্রীর প্রসঙ্গে একটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য করে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। এখন যেমন হয়েছেন। নীলু বলল, চা খাবেন বাবা? এক কাপ চা করে দিই?
দাও। চিনি দিও না। চিনিটা শরীরের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর।
তাই নাকি বাবা?
হুঁ চিনি যেমন ক্ষতি করে, লবণও সে-রকম ক্ষতি করে। এই জন্যে প্রেসার হলে লবণ খাওয়া কমাতে বলে ডাক্তারেরা। সাদা রঙের সব খাদ্যদ্রব্যই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।
নীলু হেসে বলল, দুধ? দুধও তো সাদা?
হোসেন সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বসে রইলেন। নীলুর নিজের কাছেই খারাপ লাগতে লাগল। দুধের প্রসঙ্গটা না তুললেও হত।
আপনার চায়ে দুধ দেব বাবা?
নীলু তার শ্বশুরকে খুব ভালো মতোই চেনে। লিকার চা এক চুমুক খেয়েই তিনি বলবেন, এক চামচ চিনি দাও তো মা। চিনি দেবার পর বলবেন, আধ চামচ দুধ ও দাও, কেমন কষা-কষা লাগছে চাটা। জাল বোধহয় বেশি হয়েছে।
নীলু চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকে দেখল, হোসেন সাহেব বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। তিনি নীলুকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, হাত-পা নাড়ানাড়ি করছিল। ভাবলাম, উঠে পড়ে কিনা। কোলে নিতেই শান্ত।
চা নিন বাবা।
চায়ে চুমুক দিয়ে হোসেন সাহেব তৃপ্তির স্বরে বললেন, আহ ফাস ক্লাস চা হয়েছে মা, একটু বোধহয় চিনি দিয়েছ?
এক চামচ দিয়েছি।
ভালো করেছ। বিনা চিনির চা বিষের মতো লাগে।
নীলু বলল, সিগারেট খাবেন? দেব?
দেখি, দাও! তোমার শাশুড়ি উঠে না পড়লে হয়।
উনার উঠতে দেরি আছে।
নীলু ড্র্যার খুলে সিগারেটের প্যাকেট বের করল! হোসেন সাহেব এবং নীলুর মধ্যে এই গোপন ব্যাপার আছে! মনোয়ারা যখন ঘুমিয়ে থাকেন কিংবা বাইরে কোথাও যান, তখন হোসেন সাহেব ইতস্তত করে বলেন, বৌমা, দেখ তো শফিক তার সিগোরটের প্যাকেট ফেলে গেছে কিনা। ফেলে গেলে দাও একটা।
শফিক সিগারেটের প্যাকেট ফেলে যাবার লোক না। নীল তার শ্বশুরের জন্যে সিগারেট আনিয়ে আলাদা লুকিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে শফিকের ছোট ভাই রফিক সেখানে ভাগ বসায়।
ভাবী, গোপন জায়গা থেকে একটা সিগারেট ছাড় তো।
নীলু এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, আমার কাছে নেই।
দও না ভাবী, প্লিজ। এ-রকম কর কেন?
উপায় নেই, দিতে হয়। রফিক আয়েস করে সিগারেটে টান দিয়ে বলে, তোমার চেহারা এত মায়া-মায়া, কিন্তু আচার-আচরণ এত কঠিন কেন?
কঠিন কোথায়? দিলাম তো একটা।
তুমি বলেই একটা দিলে, পৃথিবীর অন্য সব ভাবীরা গোটা একটা প্যাকেট আনিয়ে দিত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। এখন শোন ভাবী, তুমি তোমার মেয়েলি বুদ্ধি দিয়ে একটা সমস্যার সমাধান কর। একটা কঠিন সমস্যা।
রফিক আজগুবি একটা সমস্যা হাজির করবে। সেই সমস্যার কোনো আগা নেই, মাথা নেই। যেমন, গত সপ্তাহেই সে গম্ভীর মুখে বলল, আচ্ছা! ভাবী, ধর একটা ছেলের একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। খুবই পছন্দ। রীতিমত লত যাকে বলে। এখন ছেলেটা মেয়েটাকে সেই কথাটা বলতে চায়, বা নিজের অনভূতির ব্যাপারটা মেয়েটাকে বুঝতে দিতে চায়। কী ভাবে সেটা করা উচিত?
নীলু হাসিমুখে বলল, মেয়েটা কে?
মেয়ে যেই হোক। তুমি সমস্যাটার সমাধান কর।
ছেলেটা একটা চিঠি লিখবে কিংবা বলবে মুখে।
তুমি একেবারে পাগল-ছাগলের মতো কথা বলছি ভাবী। আমি চাচ্ছি। একটা ইউনিক কিছু। যেখানে হাই ড্রামা থাকবে, সাসপেন্স থাকবে।
তাহলে এক কাজ কর। মেয়েটার সামনে হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়। তারপর গড়গড়ি খেতে থাক। যখন চারদিকে লোকজন জমে যাবে এবং মেয়েটিও এসে পাশে দাঁড়াবে তখন ফিসফিস করে বল।
একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে তোমার কাছ থেকে এরকম ঠাট্টা-তামাশা আশা করি নি। মোষ্ট আনফরচুনেট।