ট্যাঁ-ট্যাঁ করে একটি বাচ্চা কাঁদছে। এটি কি তার বাচ্চা? এক জন নার্স কী যেন বলছে, কিছুই কানে যাচ্ছে না। নীলু চোখ মেলতে চেষ্টা করল, চোখ পাথরের মতো ভারি। কিছুতেই মেলে রাখা যাচ্ছে না। রাজ্যের ঘুম চোখে। চারপাশে কারা যেন হাঁটাহাঁটি করছে। মুখের ঠিক উপরে হলুদ আলো। চোখ বন্ধ, তবুও সে আলো কেমন করে যেন চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
কাঁদছে! একটা ছোট্ট শিশু কেমন অদ্ভূত শব্দে কাঁদছে। বড়ো দেখতে ইচ্ছা করছে। নীলু ঘুমের অতলে তলিয়ে যাবার আগে পরিষ্কার শুনল, শাহানা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছে।–ভাবী, তাকিয়ে দেখ তোমার বাবুকে।
নীলু, ঘুমের মধ্যেই হাসতে চেষ্টা করল। নতুন শিশুটি কঠিন কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পৃথিবীর কোনো কিছুই এখন আর তার ভালো লাগছে না। পৃথিবীর আশা, আনন্দ, সুখ একদিন হয়তো তাকে স্পর্শ করবে, কিন্তু আজ করছে না। সে তার ছোট ছোট হাত মুঠি পাকিয়ে ক্রমাগত কাঁদছে।
বাবু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে
বাবু হাত-পাছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।
ঘুমের মধ্যেই কী কারণে যেন তার নিচের ঠোঁট বেঁকে গেল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল নীলু। কী অপূর্ব দৃশ্য! এমন মায়া লাগে! চোখে পানি এসে যায়, বুকের কাছটায় ব্যথা-ব্যথা করে। নীলুমৃদুস্বরে ডাকল, এই বাবু এই! বাবুর বাঁকা ঠোঁট আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আঁহ কেন এত মায়া লাগে? নীলু নিচু হয়ে তার কপালে চুমু খেল। কেমন বাসি শিউলি ফুলের গন্ধ বাবুর গায়ে। কী অদ্ভুত সেই গন্ধ!
ভাবী।
নীলু চমকে সরে গেল। কারো সামনে বাবুকে আদর করতে তার বড়ো লজ্জা লাগে। শাহানা হাসিমুখে দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবু জেগেছে ভাবী?
নাহ্!
জাগলেই আমাকে খবর দেবে। আমি কোলে নেব।
ঠিক আছে, দেব।
এ তো দেখি রাতদিনই ঘুমায়! এত ঘুমায় কেন?
কি জানি।
শাহানা এসে বসল বাবুর পাশে।
কী ছোট ছোট কান দেখেছ? ইদুরের কানের মতো। তাই না ভাবী?
হুঁ।
ছোট কান যাদের, তাদের রাগ খুব বেশি হয়। ওর খুব রাগ হবে, মার চেয়েও ও বেশি রাগী হবে।
নীলু কিছু বলল না। শাহানা বাবুর হাত ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ, তারপর ইতস্তত করে বলল, ওকে কোলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটু বসব ভাবী?
ঘুম ভাঙার আগেই?
হুঁ।
ঠিক আছে, নিয়ে যাও। এসো, আমি কোলে তুলে দিই।
শাহানা হাত পেতে বসল। নীলু। ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল। বাবুকে সে খুব কম সময়ের জন্যেই কাছে পায়। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই তার শাশুড়ি মনোয়ারা এসে বাবুকে নিয়ে যান।
রোদ উঠলেই বাচ্চাকে তেল মাখাতে বসেন। তেল মাখানো এত প্রবল বেগে চলে যে নীলুর ভয়-ভয় লাগে। পট করে একটা নরম হাড় হয়তো ভেঙে যাবে। তেল মাখানোতেই শেষ নয়। তিনি নাক ঠিক করতে বসেন, দীর্ঘ সময় ধরে নাক টিপে টিপে ধরেন, যাতে ভবিষ্যতে বাচ্চার খাড়া নাক হয়। তারপর বুড়ো আঙুল দিয়ে থুতনিতে অল্প অল্প চাপ দেন। দীর্ঘ সময় ধরে। এরকম করলে বাচ্চার মুখ পরবর্তী সময়ে ফজলি আমের মতো হবে না।
বেলা এগারটার দিকে বাবুর গোসল হয়। নীলুর খুব ইচ্ছা গোসলটি সে নিজে করায়, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে সুযোগ পায় নি। এক দিন ভয়ে-ভয়ে বলেছিল, আমার কাছে দিন মা, আমি করিয়ে দিই।
মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, তুমি এসব পারবে না। কানে পানি ঢুকবে। কান পচবে। তোমাকে যেটা করতে বলছি, সেটা কর। গরম পানি মিশিয়ে গোসলের পানিটাকে কুসুম গরম কর।
পানি কুসুম গরম করাও একটা দীর্ঘ ঝামেলার কাজ। লাল প্লাষ্টিকের গামলায় নীলু। কেতলি থেকে গরম পানি ঢালে। মনোয়ারা হাত ড়ুবিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, এ কি কাণ্ড বৌমা! এ তো আগুন-গরম পানি! যাও, ঠাণ্ডা পানি এনে মেশাও।
ঠাণ্ডা পানি মেশানোর পর তিনি আবার চেঁচিয়ে ওঠেন, এ তে দেখি বরফের মতো ঠাণ্ডা করে ফেললে। কোনো একটা কাজও কি ঠিক মতো পার না?
গোসলের পরপরই বাচ্চার খিদে পায়। সেই দুধ খাওয়ানোর পর্বেও মনোয়ারা পাশে বসে থাকেন। নীলুর বড়ো লজ্জা লাগে। কিন্তু কোনো উপায় নেই।
মনোয়ারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখেন।
এ কি বৌমা, বুকের সঙ্গে এভাবে চেপে ধরে আছ কেন? দম বন্ধ করে মারতে চাও নাকি? মাথাটা আরেকটু উঁচু করে ধর। আহ আঁচল ধরে এত টানাটানি করছ, কেন? এখানে পুরুষমানুষ কি কেউ আছে যে লজ্জায় মরে যাচ্ছে?
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর মনোয়ারা খানিকক্ষণের জন্যে ঘুমুতে যান। তখন আসেন নীলুর শ্বশুর হোসেন সাহেব। তিনি মাস ছয়েক হল রিটায়ার করেছেন। ঘরে বসে থাকার নতুন জীবনযাত্রায় এখনো নিজেকে পুরোপুরি অভ্যস্ত করে তুলতে পারেন নি। নানান ধরনের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছেন। কোনোটিতেই সফল হন নি। ইদানীং হোমিওপ্যাথির বইটই খুব পড়ছেন। তাঁর ধারণা হয়েছে, হোমিওপ্যাথির পরে চিকিৎসাশাস্ত্রে এখনো কিছু তৈরি হয় নি। ঠিক মতো লক্ষণ বিচারটাই হচ্ছে আসল কথা।
নীলু তার শ্বশুরকে খুবই পছন্দ করে। সব সময় চেষ্টা করে তাঁর জন্যে বাড়তি কিছু করতে। সেটা কখনো সম্ভব হয় না। বাঁধা আয়ের বড় সংসারে কারো জন্যে বাড়তি কিছু করা যায় না।
দুপুরে মনোয়ারা ঘুমিয়ে পড়লে হোসেন সাহেব আসেন। দরজার বাইরে থেকে চাপা গলায় বলেন, টুনী কি ঘুমাচ্ছে বৌমা?
জ্বি, বাবা। আসুন।
তিনি এসে হাসিমুখে বিছানার পাশে বসেন। নিচুস্বরে ডাকেন, টুনি, টুনি। টুনটুনি, ঝুনঝুনি, খুনখুনি, শুনশুনি।