কিছু করতে হবে না। তুমি পড়তে বস তো। আমার শরীর এখন ভালোই।
সত্যি বলছ?
হুঁ। শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন?
শাহানার পড়ায় আর মন বসছে না। তাবী কেমন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। এমন মায়া লাগছে দেখতে! শাহানার মনে হল, এই পরিবারে এসে ভাবী ঠিক সুখী হয় নি। বিয়ের পর সব মেয়েরাই নিজের একটা আলাদা সংসার চায়। ভাবীও নিশ্চয়ই চায়। কিন্তু এখানে ভাবীর কোনো আলাদা সংসার নেই।
মাসের এক তারিখে সংসারের পুরো টাকাটা মার হাতে তুলে দেয়। সব কেনাকাটা হয় মার হাতে। ডাল রান্না হবে না। আলুভাজা হবে, এই সামান্য জিনিসটাও মাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হয়। মার মেজাজের দিকে লক্ষ রেখেই ভাবী সব কিছু করে, তবু মাঝে মাঝে মা এমন খারাপ ব্যবহার করেন যে শাহানার নিজেরই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে।
একবার ভাবী তার নিজের মার অসুখের খবর শুনে এক শটা টাকা পাঠাল মানিঅৰ্ডার করে। তার রশিদ এসে পড়ল মার হাতে। তিনি এমন হৈচৈ শুরু করলেন, সব টাকা পয়সা পাচার হয়ে যাচ্ছে গোপনে। নিজেদের যেখানে চলে না… ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভাবী লজ্জায় অপমানে নীল হয়ে গেল। কিন্তু একটি কথাও বলল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে লাগল। ভাবী না হয়ে অন্য কোনো মেয়ে হলে কী যে কাণ্ড হত কে জানে! খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিত নিশ্চয়ই। কিন্তু ভাবী খুব স্বাভাবিক। যেন তেমন কিছু হয় নি। বিকেলে ঠিকই রান্না করল। রাতে সবাইকে খাইয়ে নিজে শাশুড়ির সঙ্গে খেতে বসল।
মা তখন আবার টাকার প্রসঙ্গ তুললেন, বৌমা শোন, কিছু কিছু মেয়ে আছে, স্বামীর বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করতে পারে না। সুযোগ পেলেই বাপের বাড়িতে যা পারে। পাচার করতে চেষ্টা করে। মনে করে সেটাই আসল জায়গা। এটা ঠিক না। বিয়ের পর বাড়ি একটাই-স্বামীরবাড়ি।
ভাবী শান্ত স্বরে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি আর পাঠাব না। আর যেটা পাঠিয়েছি, সেটা সংসারের টাকা না। আমার নিজের টাকা।
তোমার আবার টাকা এল কোত্থেকে।
ও আমাকে মাঝে মাঝে কিছু হাতখরচ দেয়। সেটা আমি খরচ করি না।
তোমার আবার আলাদা হাতখরচের দরকারটা কি? তুমি তো আর স্কুল-কলেজে যাও না যে রিকশা ভাড়া, বাস ভাড়া লাগবে? আর হাতখরচের সেই টাকাও তো সংসারের টাকা, ঠিক না?
জানালায় আবার খটখট শব্দ হচ্ছে। শাহানা ভয়ে ভয়ে ডাকল, ভাবী, ও ভাবী। নীলু উঠে বসল।
কি?
জানালায় কিসের যেন শব্দ হচ্ছে।
বাতাসের শব্দ। তুমি দেখ তো শাহানা কটা বাজে?
আটটা।
মাত্র আটটা?
কী হয়েছে ভাবী?
নীলু। জবাব দিল না। হঠাৎ তলপেটে একটা তীব্র ও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা বোধ করল। অন্য কোনো শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। এর জাত আলাদা। নীলুর চোখ ভিজে গেল। সোফা আঁকড়ে ধরে সে ব্যথার ধাক্কা সামলাতে চেষ্টা করল।
এ-রকম করছ কেন ভাবী?
নীলু ক্ষীণস্বরে বলল, মরে যাচ্ছি শাহানা শাহানা কী করবে ভেবে পেল না। তার গা কাঁপতে লাগল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নে চিলেকোঠার ঘরটায় থাকে। সে নাকি? শাহানা গলা ফাটিয়ে ডাকল, আনিস ভাই, আনিস ভাই। কেউ জবাব দিল না।
শাহানা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ফুটফুটে অন্ধকার, রাস্তায় বাতি নেই। সে ছুটে গেল। ডানদিকের একতলা বাড়িতে। বাড়িওয়ালা রশীদ সাহেব তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে থাকেন। সে বাড়ি তালা-বন্ধ। দোতলার বাড়িতেও কোনো পুরুষমানুষ নেই। রোগা এক জন মহিলা (যাকে শাহানা আগে কোনো দিন দেখে নি) বিরক্ত স্বরে বলল, ছোটাছুটি করে তো লাভ হবে না–টেলিফোন কর হাসপাতালে।
কোথায় আছে টেলিফোন?
রাস্তার ওপাশে হলুদ রঙের বাড়িটাতে যাও। বাড়ির সামনে কাঁঠাল গাছ আছে। চিনতে পারছি?
শাহানা চিনতে পারল না–তবু ছুটে গেল। হলুদ বাড়ি। সামনে কাঁঠাল গাছ। রাস্তার দু পাশেই ঘন অন্ধকার। শীতের জন্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছে সবাই। কেমন ভূতুড়ে লাগছে চারদিক। পান-বিড়ির একটি দোকানে কয়েক জন ছোকরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে শাহানাকে। এক জন বুড়ো রিকশাওয়ালাও গভীর মনযোগে তাকিয়ে আছে।
এই শাহানা। কি ব্যাপার?
শাহানা কয়েক মুহূর্ত আনিসকে চিনতেই পারল না।
খালিপায়ে কোথায় যাচ্ছ?
বড়ো বিপদ আনিস ভাই। ভাবী যেন কেমন করছে।
বাসায় কেউ নেই?
না।
তুমি বাসায় যাও, আমি বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসি।
আনিস দৌড়ে গেল বড়ো রাস্তার মোড়ের দিকে। সেখানে মাঝে মাঝে বেবিট্যাক্সি পাওয়া যায়।
নীলুকে পিজিতে নেয়া হল রাত নটায়। মরণাপন্ন রোগীকে ডাক্তাররা নিতান্ত অবহেলায় ইমার্জেন্সিতে ফেলে রাখেন বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, সেটা বোধহয় ঠিক না।
দুজন ডাক্তার নীলুকে তৎক্ষণাৎ অপারেশন টেবিলে নিয়ে গেলেন। একজন আনিসকে বললেন, রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। রক্ত লাগবে। রক্তের ব্যবস্থা করুন।
শাহানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। আনিস কোনো কারণ ছাড়াই এক বার তিন তলায় উঠছে, এক বার নিচে নেমে যাচ্ছে। রক্তের ব্যবস্থা কী ভাবে করতে হয়, সে কিছুই জানে না।
রাত নটা একচল্লিশ মিনিটে এক জন ডাক্তার এসে শাহানাকে বললেন, খুকি, কান্না থামাও। মেয়ে হয়েছে একটি। রোগী ভালোই আছে।
বাচ্চাটি? বাচ্চাটি?
খুব ভালো না, তবে ঠিক হয়ে যাবে।
দাড়ি-গোঁফওয়ালা ডাক্তারটি হাসলেন। শাহানার ইচ্ছা হল সে প্রচণ্ড চিৎকার করে ঢাকা শহরের সবাইকে জানিয়ে দেয়, তোমরা শোন, আমাদের ভাবীর একটি মেয়ে হয়েছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না। ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল, সে বড়ো ভয় পেয়েছে।