নীলু উঠে দাঁড়াল। ক্লান্তগলায় বলল, আমি শাহানার কাছে যাচ্ছি।
জহির বলল, আমিও কি আসব?
না, তোমার আসার দরকার নেই। তুমি এখানেই থাক।
কড়া কথা কিছু বলবেন না ভাবী, মনের যে অবস্থা।
আমি সেটা দেখব। তোমাকে ভাবতে হবে না।
শাহানা নীলুকে দেখে হাসিমুখে বলল, কবে ফিরলে ভাবী?
আজই ফিরলাম। তুমি আছ কেমন?
এই আছি। আমার কাছে থাকা না-থাকা সমান।
তোমার কোনো লজ্জা লাগছে না? লজ্জা লাগবে কেন?
আসতে না হয়।
কী বলছ তুমি ভাবী?
খবৰ্দার, আমাকে ভাবী বলবে না। ফাজিল মেয়ে।
শাহানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নীলুর এই উগ্রমূর্তি সে কখনো দেখে নি। নীলু রুদ্ধ গলায় বলতে লাগল, এতটুক মেয়ে ছিলে। চোখের সামনে বড়ো হয়েছ। কত আদর, কত মমতা। আর এই মেয়ে এমন করে? তোমার মরাই উচিত। তুমি উঠে আসে। দোতলা থেকে আমার সামনে নিচে লাফিয়ে পড়। এস বলছি।
এই বলে সে সত্যি-সত্যিই শাহানার হাত ধরে খাট থেকে নামাল। শাহানা কিছু বোঝার আগেই নিলু গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। শাহানা কাত হয়ে খাটে পড়ে গেল। সে চোখ বড়ো-বড়ো করে ভয়াত চোখে তাকিয়ে আছে। তার ফর্সা গালে আঙুলের দাগ ফুটে উঠেছে। যেন সেখানে রক্ত জমে গিয়েছে। নীলুকিয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল তার দিকে, তারপর একটি কথা না বলে নিচে নেমে গেল। জহিরকে বলল, তুমি এখন শাহানার কাছে যাও। আমি চলে যাচ্ছি।
আসুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।
তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে না। তোমাকে যা করতে বললাম, কর।
জহির দোতলায় উঠে এল। শাহানা চুপচাপ খাটে বসে আছে। মাথায় ঘোমটা। শাড়ির আঁচল এমনভাবে টানা যে মুখ দেখা যাচ্ছে না। জহিরকে দেখে সে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল। হাসিমুখেই বলল, ভাবী আমাকে মেরেছে। জহির বিস্মিত হয়ে বলল, সে কি?
দেখ না, গালে দাগ বসে গেছে।
গালের দাগ দেখাতে গিয়ে শাহানা আবার হাসল। মৃদুস্বরে বলল, ভাবী এর আগে আরো এক বার আমাকে চড় দিয়েছিল। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার এক বান্ধবী খুব খারাপ একটা বই দিয়েছিল আমাকে। কুৎসিত সব ছবি ছিল সেই বইটাতে। আমি লুকিয়ে—লুকিয়ে পড়ছিলাম। আমার হাতে এই বই দেখে ভাবী কী যে অবাক হল। কেমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তারপর আমি কিছু বোঝার আগেই একটা চড় মোরল আমাকে। হাত থেকে বই কেড়ে নিল না বা কিছু বলল না। এই ঘটনার কথা কাউকে বললও না। আমি কী যে লজ্জা পেয়েছিলাম। আজ আবার সেদিনের মতো লজ্জা পেলাম।
জহির লক্ষ করল শাহানা কাঁদছে। খুব সহজেই সেই কান্নাও তার থেমে গেল। চোখ মুছে বলল, আমাকে ভাবীর কাছে নিয়ে চল।
এখনি যাবে?
হ্যাঁ। আমার এই ব্যাপারে ভাবী। খুব কষ্ট পেয়েছে। আরেকটা কথা তোমাকে বলি-আমি আর কোনো দিন এ-রকম করব না।
তাই নাকি?
মাঝে মাঝে আমার এ!–রকম হয়। মনে হয় কেউ আমাকে ভালোবাসে না। তখন অদ্ভুত সব কাণ্ড করি। ক্লাস নাইনে যখন পড়ি, তখন এক বার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে যাবার নাম করে বের হয়ে সোজা হাঁটা। হাঁটতে-হাঁটতে যাত্রাবাড়ি বলে একটা জায়গা, সেখান পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম।
তারপর?
সেখান থেকে ফিরে এসেছি। কেউ জানে না। কাউকে বলি নি। আমি বোধ হয় একটু পাগল।
একটু না, অনেকখানি। তোমাকে আমি খুব ভালো এক জন ডাক্তার দেখাব।
দেখিও। তুমি আমার উপর রাগ কর নি তো?
না।
সত্যি না?
হ্যাঁ, সত্যি।
আমার গা ছুঁয়ে বল।
জহির হেসে ফেলল। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসল শাহানা। জহির মুগ্ধ চোখে শাহানার দিকে তাকিয়ে আছে। কী অসম্ভব রূপবতী একটি তরুণী-কুচিবরণ কন্যা রে তার মেঘবরণ চুল!
শাহানা।
বল। তোমার গান কেমন এগুচ্ছে?
মোটেই এগুচ্ছে না। সকালবেল উঠে। ভ্যা ভ্যা করতে আমার ভালোও লাগে না। আমি আর গান শিখব না। আমি পড়াশোনা শুরু করব।
খুব ভালো কথা।
মাস্টার-টাস্টার রাখতে পারবে না। আমি নিজে-নিজে পড়ব।
সে তো আরো ভালো।
কিন্তু একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
আমি যতক্ষণ পড়ব, তুমি আমার পাশে বসে থাকবে। চুপচাপ বসে থাকবে।
শর্ত খুব কঠিন বলে তো মনে হচ্ছে না।
জহির কিছু বোঝার আগেই শাহানা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। জহির কিছু বলল না, শাহানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল!
ডাক্তার সাহেবের চেহারা
ডাক্তার সাহেবের চেহারা রাশভারী। মাথাভর্তি নজরুল ইসলামের মতো বাবরি চুল। কথাও বলেন খুব কম। ঘন-ঘন নিজের মাথার চুল টানেন। দেখে মনে হয়, কোনো কারণে খুব রেগে আছেন। কণ্ঠস্বরটি খুব সুন্দর। শুনতে ভালো লাগে। এই জন্যেই বোধ হয় নিজের গলার স্বর বেশি শোনাতে চান না।
তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে টুনিকে দেখলেন। আজকালকার ব্যস্ত ডাক্তাররা এত সময় রোগীদের দেন না। ইনিও ব্যস্ত। এর ওয়েটিং রুমে রোগী গিজগিজ করছে। তবু প্রতিটি রোগীকে অনেকখানি সময় দিচ্ছেন।
ওর জ্বর-জ্বর ভাব, এটা প্রায়ই হয় বলছেন?
জ্বি।
এর আগে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?
না। বাবা হোমিওপ্যাথি করেন। টুকটাক ওষুধ দেন, সেরে যায়।
ও, আচ্ছা। আপনার মেয়ে তো খুব রূপবতী। পুতুল-পুতুল দেখাচ্ছে। কি খুকি, তুমি কি পুতুল?
টুনি হেসে ফেলল। ডাক্তার সাহেব কাগজে অতি মনোযোগের সঙ্গে কী-যেন লিখতে লাগলেন। আগের মতো সুরেলা মিষ্টি স্বরে বললেন, আমি এখানে কিছু স্পেসিফিক টেস্টের কথা লিখে দিচ্ছি। টেস্টগুলি করাতে হবে। সব জায়গায় টেস্ট ভালো হয় না। কোথায় করাবেন তাও লিখে দিচ্ছি।