হতে পারে। পৃথিবী বড়োই রহস্যময়। রহস্যের কোনো শেষ নেই।
ঢাকায় ফেরার আগের রাতে পিঠা বানানোর উৎসব হল। সেই উৎসবে গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে যোগ দিল। টুনি এক ফাঁকে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে সবাইকে দাওয়াত করে এসেছে। উঠোনে খড়ের আগুন করা হয়েছে। সেই আগুনে তৈরি হচ্ছে পোড়া-পিঠা। বিশাল আকৃতির কদাকার পিঠা। আগুনে পোড়ার পর পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তখন তা কেটে দুধে জ্বাল দিয়ে খাওয়া। শওকত কোথা থেকে এক গায়ক ধরে এনেছে। সে একটু দূরে তার একতারা নিয়ে বসেছে। তাকে ঘিরে পুরুষদের একটা দল। গায়কের নাম কেরামত মিয়া। তার গলায় সুর তেমন নেই। সুরের অভাব সে পূরণ করেছে। আবেগে। একটি চরণে টান দেবার পরই তার চোখ ছলছল করতে থাকে। তৃতীয় চরণে যাবার আগেই চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে। গায়ক কেরামত মওলা গান ধরে—
নিমের পাতা তিতা তিতা
জামের পাতা নীল,
কোথায় আমার প্রাণের মিতা
কোথায় বন কোকিল?
সবাই স্তব্ধ হয়ে গান শোনে। পুরনো সব দুঃখ হৃদয়ের অতল গহ্বর থেকে ভেসে ওঠে। বড়োই মনখারাপ করে সবাই। তবু ভালো লাগে। হৃদয়ের গহীন চাপা পড়ে থাকা দুঃখগুলি মাঝে-মাঝে দেখতে আমরা ভালোবাসি। সেই সুযোগ বড়ো একটা হয় না। কেরামত মওলার মত গ্রাম্য গায়করা কখনো কখনো তা পারেন। তাঁদের সাহায্য করে প্রকৃতি।
উঠোনের আগুন জ্বলছে। তাকে ঘিরে বসে বসে আছে বৌ-বিরো। আকাশে ছোট্ট একটা চাদ। তার হিম হিম আলো পড়েছে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে। শীতল কনকনে হাওয়া বইছে। দুখ-জাগীনিয়া পরিবেশ তো একেই বলে।
নীলুরা ঢাকায় পৌঁছাল
নীলুরা ঢাকায় পৌঁছাল সোমবার ভোরে। নীলুর ইচ্ছা ছিল সোমবারে অফিস ধরা। তা করা গেল না। নটা বাজতেই জহির এসে উপস্থিত। জহির বলল, আমার সঙ্গে একটু আসতে হবে ভাবী। দশ মিনিটের জন্যে। আমি আপনাকে অফিসে পৌঁছে দেব।
ব্যাপার কি বল তো।
তেমন কিছু না। আবার কিছুটা আছেও। ভাবী, একটু চলুন আমার সঙ্গে।
বেশ চল। আমি কাপড় বদলে নিই। তোমরা ভালো ছিলে তো?
জহির শুকনো গলায় বলল, ভালোই ছিলাম। টুনি কোথায় ভাবী?
ওর বাবার সঙ্গে গিয়েছে। ওর শরীরটা ভালো না, জ্বর। যাবার সময়ও জ্বর নিয়ে গিয়েছে। ফেরার পথেও জ্বর নিয়ে ফিরল।
জামাইয়ের খোঁজ পেয়ে হোসেন সাহেব বেরিয়ে এলেন। নীলগঞ্জের বিস্তারিত গল্প জুড়ে দিলেন।
রাস্তাঘাট চেনা যায় না। বড়ো একটা রাস্ত করে ইট বিছিয়ে দিয়েছে। রিকশা চলে। ইচ্ছা করলে তুমি গাড়ি নিয়েও যেতে পারবে। এইটুক গ্রামে চারটা টিউবওয়েল। দাঁতব্য চিকিৎসালয় একটা করেছে, ওষুধপত্র অবশ্যি তেমন নেই। আসলে দরকার ছিল একটা হোমিও হাসপাতাল। ওষুধ সস্তা, ইচ্ছা করলে বিনামূল্যে দেওয়া যায়। তাই না?
জহিল বিরস মুখে হ্যাঁ-ই দিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে যে-কেউ বলে দিতে পারবে, সে কিছুই শুনছে না। তার মন অন্য কোথাও। হোসেন সাহেব অবশ্যি বুঝতে পারছেন না। তিনি উৎসাহের সঙ্গে একের পর এক গল্প বলে যাচ্ছেন। নীলু কাপড় বদলে তৈরি হয়ে এসেছে, তখনও তাঁর গল্প থামে নি। নীলুকে বললেন, পাঁচটা মিনিট দেরি কর মা। জহিরের সঙ্গে একটা দরকারী কথা বলছি। তুমি বরং এর মধ্যে আমাদের জন্যে চট করে চা বানিয়ে আন। আমারটায় চিনি কম।
নীলু চা আনতে গেল। হোসেন সাহেব শুরু করলেন মহিষের গল্প।
মহিষ দেখেছি নাকি জহির?
দেখিব না কেন?
আরে না। ঐ দেখার কথা বলছি না। কাছে থেকে দেখা। প্রাণী হিসেবে মহিষ অসাধারণ। বড়ো ঠাণ্ডা প্রাণী। দেখতেই বিশাল, কিন্তু এর মনটা শিশুদের মতো।
তাই বুঝি?
আমি অবাক হয়েছি। এই টুনি, পর্বতের মতো এক মহিষের পিঠে বসে থাকত। সে দিব্যি বসে আছে, আর মহিষ নিজের মনে হেলেন্দুলে ঘাস খাচ্ছে।
বাহ, চমৎকার তো।
জিনিসটা নিয়ে আমি টেনে আসতে আসতে অনেক চিন্তা করলাম। আমার ধারণা, মহিষকে যদি ঠিকমতো টেনিং দেওয়া যেত, তাহলে ঘোড়ার মতো একে ব্যবহার করা যেত। এই জিনিসটা কারোর মাথায় খেলে নি। তুমি কী বল?
হতেপারে।
মহিষের পিঠে বসাও খুব আরামের। পিঠ অনেক চওড়া। জিন ব্যবহার করার দরকার হত না।
শেষ পর্যন্ত জহির বলতে বাধ্য হল, আমি পরে এসে বাকিটা শুনব। আমার একটা বিশেষ জরুরি কাজ।
সন্ধ্যাবেলা চলে এস! শাহানাকে নিয়ে এস, অনেক গল্প বাকি রয়ে গেছে।
আচ্ছা দেখি।
দেখাদেখির কিছু না। নিয়ে আসবে। রাতে আমাদের সঙ্গে খাবে। মনে থাকে যেন।
জ্বি, মনে থাকবে।
আসল গল্পগুলিই বলা হয় নি।
জহিরের কথা শুনে নীলু আকাশ থেকে পড়ল। তার মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না। সে বহু কস্টে বলল, এসব তুমি কী বলছি।
যা ঘটেছে, তাই বললাম।
আমাদের খবর দিলে না কেন?
আপনারা আনন্দ করতে গিয়েছেন। এর মধ্যে হঠাৎ তাঁবু খবর নিশ্চয়ই দিতাম। দেখলাম, খবর না দিয়ে যদি পারা যায়।
শাহানা এখন আছে কেমন?
এখন ভালো।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে?
হ্যাঁ। গতকালসন্ধ্যায়বাসায় এনেছি। কথা হচ্ছিল জহিরদের বাড়ির একতলায়। নীলু বলল, তুমি আবার গোড়া থেকে বল কী হয়েছে।
আপনারা যেদিন নীলগঞ্জ গেলেন, ঐদিনই ঘটনা ঘটল। সারা দিন দরজা বন্ধ করেছিল। রাত দশটার সময় কাজের মেয়েটা বলল-সে নাকি ধাপ করে কি পড়ার শব্দ শুনেছে। আমি দরজা ধাক্কা দিলাম। শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলাম। তখনও বুঝতে পারি নি, ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন। যমে-মানুষে ন কাকে বলে এই প্রথম দেখলাম। ডাক্তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে, ভাবী। ওরা অসাধ্য সাধন করেছে।