ঢাকায় ফিরেই এক জন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আমাকে মনে করিয়ে দিও।
নীলু বলল, জানালাটা একটু খুলে দেবে? বাইরের দৃশ্য দেখব।
ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকবে।
অল্প একটু খোল।
শফিক পুরোটাই খুলে দিল। আকাশে চাঁদ নেই, তবু নক্ষত্রের আলোয় আবছাভাবে সবকিছু চোখে পড়ে। নদীর পানি ঝিকমিক করে জ্বলে। খোলা মাঠ থেকে চাপা আলো বিছুরিত হয়। কী অদ্ভুত লাগে দেখতে। এই সব দৃশ্য যেন পৃথিবীর দৃশ্য নয়। এদের হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়।
তারা চার দিন কাটাল নীলগঞ্জে।
টুনির আনন্দের সীমা নেই। এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে ঘরে পাওয়া যায় না। বাবলুর সঙ্গে সারাদিন রোদে রোদে ঘুরছে। বাবলুও আগের মতো নেই, তার মুখে কথা ফুটেছে। এই কদিনেই গ্রামের কথা বলার টান তার গলায় চলে এসেছে। টুনিকে এই ব্যাপারটি খুব অবাক করেছে। সেও টেনে-টেনে কথা বলার চেষ্টা করছে, মনোয়ারা যা একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না। তিনি টুনিকে চোখে-চোখে রাখার চেষ্টা করেন। পারেন না। তাঁর সবচে বড়ো ভয় কখন এই মেয়ে হুঁট করে পানিতে নেমে যায়। চোখে–চোখে রেখেও কোনো লাভ হয় না। সুযোগ পেলেই পানিতে নেমে পড়ে। টুনি পানিতে নেমেছে, এই খবর শুনলেই তিনি বিশ্ৰী রকমের হৈচৈ শুরু করেন। নীলুকে বলেন, তুমি হচ্ছি মা, তোমার গায়ে লাগে না? চুপচাপ আছ। মেয়েটাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখি।
ওর কিছু হবে না মা। ওর সঙ্গে সব সময় একদল ছেলেপুলে থাকে, ওরা দেখবে। গ্রামের ছেলেমেয়ে, ওরা হল পানির পোকা।
কথা সত্যি, টুনির সঙ্গে থাকে বিরাট এক বাহিনী। শওকত এক দিন এক মহিষ ধরে আনল। বিশাল মহিষ টকটকে রক্তবর্ণ চোখ, বাঁকান শিং। মনোয়ারা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, কী সর্বনাশ! এই আজরাইল উঠানে কেন? শওকত হাসিমুখে বলল, বড়ো ঠাণ্ডা জানোয়ার, টুনির জন্যেই আনলাম।
কী বলছ তুমি। টুনি এটা দিয়ে কী করবো?
উপরে বসব।
পাগল নাকি!
খুব ঠাণ্ডা জানোয়ার।
বের হও! এক্ষুণি এটা নিয়ে বিদেয় হও। পাগলের কারবার। বলে কী, ঠাণ্ডা জানোয়ার।
শওকত মহিষ নিয়ে বের হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরই মনোয়ারা আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করলেন, টুনি সেই মহিষের পিঠে। মহিষ গদাইলঙ্করি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পেছনে একদল ছেলেপূলে। নীলু মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। সে বলল, একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হত। ছবি তুলে রাখা যেত। সুন্দর লাগছে, না মা?
মনোয়ারা চেঁচিয়ে উঠলেন, এর মধ্যে তুমি সুন্দর কী দেখলে? তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? এক্ষুণি ঝাড়া দিয়ে গা থেকে ফেলে দেবে।
নীলুকে তেমন উদ্বিগ্ন মনে হল না। হোসেন সাহেব এই দৃশ্যে খুব মজা পেলেন। মহিষের পিছনে-পিছনে হাঁটতে লাগলেন।
শফিক খুব আগ্রহ নিয়ে সুখী নীলগঞ্জের কর্মকাণ্ড ঘুরে ঘুরে দেখল। এতটা সে আশাই করে নি। এত দিন সে এটাকে এক জন বুড়ো মানুষের শখের ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছিল, এখন কাণ্ডকারখানা দেখে হকচকিয়ে গেছে। লাইব্রেরি ঘিরে রাজ্যের বই। এত বই শহরের কোনো লাইব্রেরিতেও নেই। দুটো পত্রিকা আসে এই গণ্ডগ্রামে। শফিক অবাক হয়ে বলল, কে পড়ে এই পত্রিকা? আপনি পড়েন, সেটা বুঝতে পারি। আর কে পড়ে?
ডাক্তারবাবু পড়েন। হরিনারায়ণবাবু!
ডাক্তার আছে নাকি?
ডাক্তার ঠিক না। সরকারী হাসপাতালের কম্পাউণ্ডার ছিলেন, এখন রিটায়ার করে এই গ্রামে আছেন।
ও, আচ্ছা।
গ্রামের লোকজনও কেউ কেউ পত্রিকা নাড়াচাড়া করে। তা ছাড়া সন্ধ্যাবেলা এক জন পত্রিকা পড়ে শোনায়। অনেকেই শুনতে আসে।
বলেন কী?
কবির মামা যে-কাজ শুরু করেছিলেন, তার সুফল দিতে শুরু করেছে।
কী রকম সুফল?
সোভাহান হাসতে-হাসতে বলল, নীলিগঞ্জের মেয়েদের বিয়ের বাজারে খুব কাটতি। আশপাশের গ্রামের সবাই মনে করে, নীলগঞ্জের মেয়ে মানে আদব-কায়দার মেয়ে। এখানকার কোনো মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয় না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, কবির মামার নিষেধ ছিল। যৌতুক দিয়ে কোনো মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। কবির মামার জীবদ্দশায় এটা মানা হত না। এখন মানা হয়।
আমার তো ভাই রূপকথার মতো লাগছে।
আসলেই রূপকথা। বেশির ভাগই হয়েছে ওনার মৃত্যুর পরে। যেমন গ্রামের ভেতরের রাস্তাগুলি। কেউ নিজের জায়গার এক ইঞ্চি ছাড়তে রাজি নয়। মামা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। তাঁর মৃত্যুর তিন দিনের দিন সবাই ঠিক করল, কবির মাস্টার যে-সব রাস্তা চেয়েছিলেন, সেগুলি করে দেওয়া হবে। করাও হল তাই। লোকটি যখন বেঁচে ছিল, তার মর্ম কেউ বোঝে নি।
আপনি কি ওনার বাকি কাজ শেষ করতে নেমেছেন?
হ্যাঁ, তাই।
কী মনে হয়, পারবেন?
হয়তো পারব। খুবই কঠিন কাজ। দীর্ঘদিনের কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অন্ধকার-চট করে এগুলি যায় না। সময় লাগে। আমিও হয়তো পারব না, অন্য এক জন আসবে। এটা হচ্ছে একটা চেইন রিঅ্যাকশন। শুরুটাই মুশকিল। এক বার শুরু হলে চলতে থাকে।
ঠিক বলেছেন। শুরুটাই ডিফিকাল্ট।
গ্রামের লোকদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যে আমি খানিকটা প্রতারণাও করছি। তাও কাজে লাগছে।
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না। কী ধরনের প্রতারণা?
নামাজ পড়ছি নিয়মিত। যদিও ধর্ম, বিধাতাপুরুষ এসব জিনিসে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু যেহেতু ধর্মপ্রাণ মানুষদের জন্য গ্রামের লোকদের খুব মমতা, আমি তার সুযোগ নিচ্ছি।
শফিক হেসে ফেলে বলল, কে জানে এক দিন হয়তো দেখা যাবে, ভান করতে করতে আপনি ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। বেরুতে পারছেন না। বিরাট বুজুর্গ ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।