কী ব্যাপার, বল।
বুঝতেই পারছেন, শাহানাকে নিয়ে একটা সমস্যা। আজ ভোরবেলায় নাস্তা খাবার সময় সামান্য একটু কথা কাটাকাটি হল। তার পরপরই সে ছুটে তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সেই বন্ধ দরজা এখনও খোলেনি। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থা বলতে পারেন। মানে এই জাতীয় অবস্থায় পড়ে আমার অভ্যাস নেই। খুব বিব্রত বোধ করছি।
কথা কাটাকটি কী নিয়ে হচ্ছিল?
আনিস সাহেবকে নিয়ে। ও বলল, আনিস সাহেবকে এক দিন দাওয়াত করে খাওয়াতে চায়। আমি বললাম-খুব ভালো কথা। ওনাকে এবং ওনার স্ত্রীকে বল। তাতেই ও রেগে আগুন।
আমি বুঝলাম না, তাতে রেগে আগুন হবার কী?
আমি বুঝতে পারি নি। শাহানা বলেছিল—তুমি এখানে তার স্ত্রীর কথা কেন বললে? তোমার কি ধারণা, আমি শুধু তাকে একা খেতে বলব? তা যদি চাইতাম, তাহলে তো অনেক আগেই বলতে পারতাম। তা তো বলি নি। বিশ্ৰী ব্যাপার, ভাবী। কাজের লোকদের সামনে হৈচৈ চিৎকার। প্ৰায় হিস্টিরিয়ার মতো অবস্থা।
শাহানার কথা শুনে তুমি কী বললে?
আমি কিছু বলি নি। যা বলার মনে-মনে বলেছি। লোকজনের সামনে সিন ক্রিয়েট করতে চাই নি।
চল তোমার সঙ্গে যাই, ওকে নিয়ে আসি।
বাদ দিন, ভাবী। আপনারা ঘুরে আসুন। নীলগঞ্জ গিয়ে আরো ঝামেলা করবে। আপনাদের আনন্দই মাটি করবে।
আমি সব ঠিক করে দেব।
কোনো দরকার নেই, ভাবী। এই ব্যাপারটা আমিই ঠিক করতে চাই। বিশ্বাস করুন, আমি ভালোমতোই করব।
ও খুবই ছেলেমানুষ জহির। ওর বয়সটা দেখ।
আমি জানি। চলুন নিচে যাই। আপনাদের অনেক গোছগাছ বাকি। আমি গাড়ি রেখে যাচ্ছি, আপনাদের টেনে তুলে দেবে।
শারমিনের না যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে মনোয়ারা নতুন করে কথা তুললেন। এই প্রসঙ্গ নিয়ে গত কদিন ধরেই তিনি চেঁচামেচি করছেন। রফিকের সঙ্গে এক দিন তুমুল ঝগড়া হল। শারমিন এ বাড়িতে আসছে না কেন, এর জবাবে রফিক বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমি কী করে বলব? সেটা শারমিনকে জিজ্ঞেস করা। ওটা তার ব্যাপার। হয়তো এ বাড়ি তার ভালো লাগছে না।
এ বাড়ি ভালো লাগবে না কেন?
খুব সম্ভব তোমার জন্যেই লাগে না। দিন-রাত ক্যাচ ক্যাচ কর।
দিন-রাত ক্যাচ ক্যাচ করি?
রফিক এই প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে কেটে পড়ল। মনোয়ারা সারাদিন হৈচৈ করে কাটালেন। আজ আবার শুরু হল। নীলু, টিফিন কেরিয়ারে খাবারদাবার ভর্তি করছিল। মনোয়ারা তাকে ধরলেন, বৌমা, হচ্ছেটা কী? নীলু বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের কথা বলছেন?
ছোট বৌমা এ বাড়িতে আসে না কেন?
নীলু বলল, অনেক দিন পরে বাবার বাড়ি গিয়েছে, কটা দিন থাকছে, থাকুক না। নীলগঞ্জ থেকে ফিরে এসে আমি ওকে এ বাড়িতে নিয়ে আসব। এখন নিজের বাড়িতেই থাকুক।
নিজের বাড়ি তুমি কী বলছি? বিয়ের পর মেয়েদের বাড়ি থাকে একটাই। সেটা হচ্ছে স্বামীর বাড়ি।
আপনাদের সময় তাই ভাবা হত। এখন দিনকাল পাল্টেছে।
কী রকম পাল্টেছে? এখন বুঝি আর স্ত্রীরা স্বামীদের বাড়িতে থাকে না? তাহলে তুমি এখানে পড়ে আছ কেন?
নীলু কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, আপনার কি সব গোছগাছ হয়েছে মা?
গোছগাছ আর কী করব? আমার হল গিয়ে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। সংসারে কী শুরু হয়েছে, কিছু বুঝতে পারছি না।
রাত আটটায় স্টেশনের দিকে রওনা হবার কথা। হোসেন সাহেবের দেখা নেই। শেষ মুহূর্তে তাঁর মনে হয়েছে দুটি খুবই প্রয়োজনীয় ওষুধ তাঁর সঙ্গে নেই। একটি হচ্ছে নাকসমৃভমিকা, অন্যটি পালসেটিলা। গ্রামে যাচ্ছেন, দরকারের সময় হাতের কাছে ওষুধ পাওয়া যাবে না, বিপদে পড়তে হবে। তিনি কাউকে কিছু না-বলে ওষুধের খোঁজে গেলেন।
ফিরলেন রাত সাড়ে আটটায়, যখন সম্বাই প্ৰায় নিশ্চিত যাওয়া হবে না। স্টেশনে রওনা হবার সময়ও কেউ জানে না, ট্রেন ধরা যাবে কি যাবে না। টেন অবশ্যি ধরা গেল। এবং টেন ছেড়ে দেবার পর জানা গেল, তাড়াহুড়োয় মনোয়ারার সুটকেসটাই আনা হয় নি। তিনি মুখ হাঁড়ির মতো করে নীলুকে বললেন, আমার জিনিসের দিকে কেউ কি আর লক্ষ রেখেছে? তা রাখবে কেন? আমি কি একটা মানুষ?
ট্রেনে ওঠার উত্তেজনা, নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দে। টুনির জ্বর এসে গেল। হোসেন সাহেব তাকে এক ফোঁটা পালসেটিলা টু, হানড়েড় খাইয়ে হাসিমুখে শফিককে বললেন, ওষুধটা সঙ্গে না থাকলে কী অবস্থা হত চিন্তা করেছিস? তোরা খামোকা হৈচৈ করিস, কিছু বুঝিস না।
টুনির জ্বর এসে যাওয়ায় তাঁকে অত্যন্ত আনন্দিত মনে হল।
কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম। ট্রেন ছুটে চলেছে। গফরগাঁয়ে অনেকক্ষণ লেট করেছে, সেটা বোধহয় কাটিয়ে উঠতে চায়। নীলু ছাড়া বাকি সবাই ঘুমিয়ে। নীলুর ঘুম আসছে না! শীতের দিন! জানালার কাঁচ ওঠানো যাচ্ছে না। তার খুব ইচ্ছে করছে, কাঁচ উঠিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে–অন্ধকার গ্রামের উপর হালকা জোছনা। কে জানে, আজ হয়তো জোছনা হয় নি। গাঢ় আঁধারে চারদিক ঢাকা। মাঝে মাঝে দূরে-বহু দূরে কুপি জ্বলছে; কোনে! জায়গায় লক্ষ লক্ষ জোনাকি একসঙ্গে জ্বলছে আর নিভছে। বন্ধ ট্টেনের কামরা থেকে এসব দৃশ্যের কিছুই দেখার উপায় নেই। নীলু, মেয়ের কপালে হাত রাখল। জ্বর মনে হয় আরো বেড়েছে। সে তার উপর কম্বলটা ভালোমতো টেনে দিল। মাথা কান্ত হয়ে ছিল-সোজা করে দিল!
শফিক বলল, য়ফাঙ্কে কি চা আছে নীলু?
আছে। তুমি ঘুমাও নি?
উঁহু, চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিলাম। গাড়িতে আমার ঘুম আসে না।
শফিক উঠে নীলুর পাশে বসল। নীলু কাঁপে চা ঢালতে-ঢালতে বলল, মেয়েটা দুদিন পরপর জ্বরে ভোগে, ওকে এক জন ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার।