ভাই, আপনি এসব কী বলছেন?
যা বলছি সত্য বলছি। একটা শব্দও মিথ্যা না। যান, বাড়ি যান। যা করতে বললাম করেন। চিঠি পড়ে কোনো নাম-ঠিকানা পেলে আমাদের খবর দেবেন-টাইট দিয়ে দেব।
তিনি বাড়ি ফিরলেন ঘোরের মধ্যে। কয়েক বার এমন হল, যেন রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন। শরীর দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে। তাঁর ধারণা হল, হাট অ্যাটাক হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের সময় নাকি খুব ঘাম হয়।
কী করে বাড়ি পৌঁছলেন তিনি নিজেই জানেন না।
বারান্দার একটা মোড়াতে আনিস বসে আছে। বাড়ির ভেতর বেশ কিছু লোকজন। এদের গোলমাল ছাপিয়েও লতিফার গলা ছেড়ে কান্না শোনা যাচ্ছে। তিনি কাঁপা গলায় আনিসকে বললেন, এখনও পাওয়া যায় নি? আনিস বিব্রত স্বরে বলল, বীণার কথা বলছেন তো? ওকে নিয়ে এসেছি।
নিয়ে এসেছ? কোথায় ছিল সে?
ইয়ে, মানে আমার ওখানে একটা বিশেষ প্রয়োজনে–বিশেষ প্রয়োজনে তোমার কাছে? শুয়োরের বাচ্চা, তুমি মানুষ চেন না? জুতিয়ে আমি তোমার দাঁত খুলে ফেলব, বেইমান, নিমকহারাম-
তিনি সত্যি সত্যি তাঁর স্যাণ্ডেল খুলে ফেললেন। হৈচৈ শুনে ভেতরের বাড়ির সবাই বেরিয়ে এল। লতিফা এসে স্বামীর হাত ধরে প্রায় টেনে হিচড়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। হিসহিস করে বললেন, কেলেঙ্কারি। আর বাড়িও না। যা হবার হয়েছে। এই রাতেই মেয়ের আমি বিয়ে দেব।
কী বলছ এসব? কার সাথে বিয়ে দেবে? এই হারামজাদাটার সঙ্গেই দেব, উপায় কী? এত রাত পর্যন্ত এক সঙ্গে ছিল। কিনা, কী হয়েছে কে জানে। আগুন আর ঘি।
তিনি হতভম্ব হয়ে হয়ে পড়লেন। লতিফা কাঁদতে-কাঁদতেই বললেন, দাঁড়িয়ে থেক না। কাজীর জোগাড় দেখা।
মাথাটা তোমার খারাপ হয়ে গেল নাকি? ঐ হারামজাদাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াব। জুতাপেটা করব।
লতিফা কঠিন স্বরে বললেন, আমি কোনো কথা শুনব না। আজ রাতেই বিয়ে হবে। মেয়ে কি না কি করে এসেছে, আমার গা ঘিনঘিন করছে। বমি এসে যাচ্ছে।
সত্যি তিনি হাড়হড় করে একগাদা বমি করলেন।
রাত বারটা পঁয়ত্ৰিশ মিনিটে আনিসের বিয়ে হয়ে গেল। লতিফা ট্রাকে তুলে রাখা তাঁর নিজের বিয়ের শাড়িতে বৌ সাজালেন। শফিকের একটা ধোয়া পাঞ্জাবি আনিসকে পরানো হল। পাঞ্জাবি একটু বড়ো হল। কাঁধের বুল অনেকখানি নেমে গেল, তবু সেই মাপে বড়ো ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবিতে অপূর্ব দেখাল আনিসকে। লতিফারাও এক সময় মনে হল, ছেলেটার চেহারা তো ভালোই। সুন্দরই তো লাগছে। মেয়ে জামাই খারাপ কেউ বলবে না।
শুধু বীণার বাবা কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ করলেন না। অন্ধকার বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইলেন। হোসেন সাহেব গেলেন কথাবার্তা বলে তাঁর মন ভালো করে দিতে। বিভিন্ন দিকে তিনি চেষ্টা করলেন। সব শেষে অত্যাশ্চর্য ওষুধ পালসেটিলা নিয়ে কথা বলা শুরু করতেই বীণার বাবা বললেন, এত ফালতু কথা বলেন কেন? ভ্যাজার-ভাঁজর করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন। যান, বাড়িতে গিয়ে ঘুমান।
চিলেকোঠার ঘরে তাড়াহুড়া করে বাসর সাজান হয়েছে। আশপাশের বাড়ির মেয়েরা এসে জুটেছে। এদের আনন্দের কোনো শেষ নেই। সমস্ত ছাদ জুড়ে ছোটা-ছুটি। একটি রেডিওগ্রাম আনা হয়েছে ছাদে। বিশাল দুটি স্পিকারে তারস্বরে গান হচ্ছে। সন্ধ্যা কিন্নরকণ্ঠে গাইছেন-ও বাক বাক বাকুম বাকুম পায়রা। অপূর্ব সুরধ্বনিতে শীতের বাতাসে যেন নেশা ধরে গেছে। আনিসের চোখ বারবার ভিজে উঠছে। সে ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। প্রায় শেষরাতের দিকে নীলু এসে বলল, আনিস, তোমার ঘরে যাও। বীণাকে আমরা নিয়ে আসছি।
আনিস কিছু বলল না। নীলু বলল, আজ আমি তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। কিছু মনে রেখো না ভাই। অন্য কারণ ছিল। আমি এমন খারাপ মেয়ে না, আনিস। আমি তোমাকে খুবই পছন্দ করি।
ভাবী, আমি তা জানি।
আজ যা হল, তোমার জন্য ভালো স্থল। বীণা একটি অসাধারণ মেয়ে। দেখবে, ও তোমার জীবনটাই বদলে দেবে।
তাও আমি জানি, ভাবী।
এস, ঘরে এস।
আপনার আঁচলে কী?
গোলাপী। টবের গাছ থেকে ছিঁড়ে এনেছি। ফুল ছাড়া কি বাসর হয়? তোমার খুব ভাগ্য ভালো। আজ অনেকগুলি গোলাপ একসঙ্গে ফুটেছে।
রাত প্ৰায় শেষ হয়ে এল। আনিস অপেক্ষা করছে। তাকে ঘিরে আছে গোলাপের সৌরভ। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না—ঘটে। এই ঘরে এমন একটি নাটক হবে, কে জানে!
আনিসের মাথা বিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসে যাচ্ছে।
বীণা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার ওপাশে। তার সঙ্গে বেশ কটি মেয়ে, সবাই চাপা হাসি হাসছে। বীণার মাথা নিচু। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে মাঝে-মাঝে কোপে-কোপে উঠছে। কাঁদছে নাকি মেয়েটা? কান্নার কী আছে?
নিমের পাতা তিতা তিতা
শেষ পর্যন্ত নীলগঞ্জ যাবার দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। দলটা মোটামুটি বড়োই। রফিক-শারমিন ছাড়া সবাই যাচ্ছে। শাহানা এবং তার বরও যাচ্ছে। শাহানার যাবার ইচ্ছা ছিল না। যাচ্ছে জহিরের কারণে। জহির কেন জানি যাবার জন্যে উৎসাহী হয়ে পড়েছে। অবশ্যি শেষ সময়ে এই দুজনও বাদ পড়ল। ট্রেন রাত নটায়। জহির সন্ধ্যাবেলা এসে বলল, একটা সমস্যা হয়েছে ভাবী। নীলু হেসে ফেলল। জহির বলল, বানানো সমস্যা নয়, সত্যি সমস্যা।
তোমরা তাহলে যেতে পারছি না?
না।
সমস্যাটা কী?
জহির ইতস্তত করে বলল, চলুন ভাবী ছাদে যাই, সেখানে বলব।
বলতে না-চাইলে বলার দরকার নেই।
ভাবী, আমি আপনাকে বলতে চাই। বলা দরকার।
নীলুচিন্তিত মুখে ছাদে উঠে গেল। নিৰ্ঘাত শাহানা খুব ঝামেলা বাঁধিয়েছে। সেই ঝামেলার প্রকৃতিটি কী, কে জানে। নিশ্চয়ই জটিল কিছু। নয়তো জহির এতটা অস্থির হত না। সে সহজে অস্থির হবার ছেলে নয়।