ছাদে তার নিজের ঘরটির দরজা খোলা। সুন্দর পর্দা ঝুলছে। কে থাকে এখানে? আনিস কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। বীণা, গভীর মনোযোগে পড়ছে। পিঠময় খোলা চুল। চেয়ারে পা তুলে কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসা। আর ঘরটি কী সুন্দর সাজিয়েছে।
এই বীণা।
বীণা চমকে উঠল।
আরো আনিস ভাই, আপনি কোথা থেকে?
আকাশ থেকে।
আসুন, ভেতরে আসুন তো।
আনিস ভেতরে ঢুকল। বীণা বলল, আপনার ঘরের দখল নিয়ে নিয়েছি।
তাই তো দেখছি।
নিরিবিলি। পড়াশোনার জন্যে এটা করলাম। আপনাকে তাড়িয়েছিও এই কারণে।
ভালো করেছ।
উপায় ছিল না, কারণ আমাকে খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সারা জীবন ফার্স্ট সেকেণ্ড হতে হবে। কেন বলুন তো?
বলতে পারছি না।
কারণ আমি এমন এক জন পুরুষকে বিয়ে করব যার কাজ হবে দিন-রাত ঘরে বসে থাকা। কাজেই চাকরি-টা করি করে এই লোককে খাওয়াতে হবে। তার জন্যেই আমার খুব ভালো রেজাল্ট দরকার। যেন পাস করলেই চাকরি হয়ে যায়। বুঝতে পাছেন?
পারছি।
এখন বলুন তো, আমি কেমন মেয়ে?
তুমি খুব জেদী মেয়ে।
ঠিক বলেছেন। আর আপনি হচ্ছেন একজন ভ্যাবদা পুরুষ। এখন বলুন, এ বাড়িতে কেন এসেছেন?
এমনি এসেছি।
না, এমনি না। নিশ্চয়ই কোনো কাজে এসেছেন।
নীলু ভাবীর কাছে এসেছিলাম।
কেন?
আমার কিছু টাকার দরকার হল, মানে ইয়ে…
পেয়েছেন টাকা?
না, ওর হাত খালি।
কত টাকা দরকার?
তোমার ব্যস্ত হতে হবে না, আমি ব্যবস্থা করব।
আহ, যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলুন—কত টাকা দরকার?
শ দুই।
বসুন। এখানে, আমি নিয়ে আসছি। খবরদার পালাবেন না।
বীণা নিচে নেমে গেল। মা-বাবা দু জনের কেউই বাসায় নেই। এক খালা আছেন, ষ্টিল আলমিরার চাবি তাঁর কাছে নেই। লতিফা তোষকের নিচে ভাংতি টাকা পয়সা রাখেন, সেখানে দুটি ময়লা ন্যাতন্যাতে পাঁচ টাকার নোট ছাড়া কিছুই নেই। বীণা খালিহাতেই উপরে উঠে এল। ক্ষীণ স্বরে বলল, আনিস ভাই, আপনি কোথায় থাকেন ঠিকানাটা লিখে যান, আমি সন্ধ্যার আগেই টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করব।
তুমি শুধু—শুধু ব্যস্ত হচ্ছে বীণা।
আমি যা বলছি করুন–এই নিন। কাগজ-কলম। পরিষ্কার করে। ঠিকানা লিখুন। আমি চা বানিয়ে আনছি, চা খেয়ে তারপর যাবেন।
বীণা আবার নিচে নেমে গেল।
সন্ধেবেলায় আনিসের বিস্ময়ের সীমা রইল না।
তার কেন জানি মনে হচ্ছিল, বীণা এ-রকম কিছু করে বসতে পারে। সত্যি সত্যি করলেও তাই। নিজেই এসে উপস্থিত। নোংরা ঘর। চারপাশের নোনাধরা দেয়াল, আস্তর উঠে-উঠে আসছে। দীনহীন পরিবেশের কিছুই মেয়েটিকে প্রভাবিত করল না। কিংবা হয়তো করেছে, সে তা বুঝতে দিচ্ছে না। সে আনিসের চৌকিতে বসে আছে বেশ সহজ ভঙ্গিতে, যেন এটাই তার ঘরবাড়ি। কথাও বলছে সহজ স্বরে।
পাশের চৌকিটায় কে থাকেন?
আমার রুমমেট।
উনি এখন নেই?
না। অফিস শেষ করে টিউশ্যনিতে যান, ফিরতে ফিরতে দশটা—এগারটা दge।
আপনারা কি নিজেরাই রান্না করেন-হাঁড়ি-পাতিল দেখছি।
হ্যাঁ, নিজেরাই করি। খরচ কম পড়ে।
রান করেন কে?
বেশির ভাগ সময় আমিই করি। আমার অবসর বেশি।
আজ কী রান্না করলেন?
এখনো কিছু করিনি।
আজকের রান্নাটা আমি করে দিই?
আনিস আঁৎকে উঠে বলল, কী বলছি এসব! তুমি কি রান্না করবে?
আপনার কি ধারণা, আমি রান্না জানি না?
জানবে না কেন? নিশ্চয়ই জোন। কোনো রকম ঝামেলা না-করে তুমি চুপচাপ বসে থাক তো।
আমি কিন্তু এখানে অনেকক্ষণ থাকব।
অনেকক্ষণ থাকব মানে?
অনেকক্ষণ থাকব মানেও জানেন না? বাংলা ভুলে গেছেন নাকি?
আনিস কী বলবে, কী করবে ভেবে পেল না। এই মেয়েটা তাকে মনে হচ্ছে সত্যি-সত্যি বিপদে ফেলবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পাশের ঘরগুলির বোর্ডাররা বারবার উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আনিস হারিকেন ধরাল। বীণা অবাক হয়ে বলল, হারিকেন কেন, আপনাদের ইলেকট্রিসিটি নেই?
ছিল। বাড়িওয়ালা এক বছর যাবত ইলেকট্রিসিটির বিল দিচ্ছে না, লাইন কেটে দিয়েছে।
বাড়িওয়ালাও মনে হয় আপনাদের মত গরিব।
আসলেই তাই। এই এতটুকু বাড়ি, এর সাত জন শরিক। শরিকে-শরিকে বিবাদ লেগেই আছে। বিবাদ মানে কঠিন বিবাদ। মারামারি হচ্ছে ভালোভাবে। পরশু এক জন আরেক জনকে রামদা নিয়ে তাড়া করেছিল।
বলেন কি?
আজও হয়তো করবে।
করে করুক। এই ঘরে না চুকলেই হল।
রাত দশটা বেজে গেছে। বীণা ফিরছে না। বীণার বাবা থানায় ডাইরি করতে গিয়েছেন। ওসি সাহেব চোখ মটকে জিজ্ঞেস করেছেন, মেয়ের কোন লভ—টভ আছে নাকি? তিনি শুকনো গলায় বলেছেন, আমার মেয়ে ঐ রকম না।
আগে ভালো করে খোঁজ নিন। মেয়ের ট্রাংক, সুটকেস এসব খুলে দেখুন চিঠিপত্র পান। কিনা। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের জিজ্ঞাসাবাদ করুন। ওরা এইসব ভালো জানবে। টাকা পয়সা কিছু নিয়ে গেছে?
তার মার কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। নিউ মার্কেট থেকে কী-একটা বই কিনবে। টেক্সটবুক।
ঐটা ফালতু কথা। যাওয়ার ভাড়া নিয়ে গেছে। সপ্তাহে এ-রকম তিন-চারটা কেইস আমরা ডিল করি। মেয়ে পালিয়ে যায়। পেয়ারের লোকের সঙ্গে। সস্তার একটা হোটেলে উঠে ফুর্তি করে।
এইসব কী বলছেন। আপনি?
সত্যি কথা বলছি রে ভাই। তাও তো সবটা বলছিনা। রেখেঢেকে বলছি। মাঝে মাঝে কী হয় জানেন? ছেলে মেয়েটাকে ভুজুখভাজৎ দিয়ে বের করে নেয়। একটা হোটেলে নিয়ে তোলে। সেই হোটেলে আগে থেকেই তার বন্ধুবান্ধব অপেক্ষা করছে। তারপর মছাবটা বুঝতে পারছেন তো? এইসব হারামজাদাদের ধরতেও পারি না। মেয়ে বা মেয়ের আত্মীয়স্বজন কেউ কেইস করে না। সম্মানহানির ভয়। মানে ইজতের ভয়। মেয়ের আবার বিয়ে দেয়ার প্রশ্ন আছে।