হঠাৎ তোমার এত উৎসাহের কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না।
তেমন জোরাল কোনো কারণ নেই। যেতে ইচ্ছা করছে। তুমি বাবা-মার সঙ্গেও কথা বল। ওঁরা যদি যেতে চান।
মনোয়ারা নীলগঞ্জে যাবার কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণ স্পষ্ট নয়। তিনি শুকনো গলায় বললেন, এইসব এখন বাদ দাও। আম-কাঁঠালের সিজনে গেলেই হবে।
টুনির আব্ৰাসবাইকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
দল বেঁধে গেলে থাকবে কোথায় শুনি? শীতের দিন। এতগুলি মানুষের লেপ-কাঁথা কে দেবে? হুঁট করে একটা কিছু করলেই তো হয় না।
শীতের লেপ-কাঁথা সঙ্গে করে নিয়ে গেলে হয় না, মা?
যদি হয় তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যাও! মুখ দিয়ে এক বার যখন বের করেছ, তখন তো এটা করবেই। যাও, নিওমোনিয়া বাধিয়ে আসে।
হোসেন সাহেব যাবার ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দেখালেন। মনোয়ারার অনাগ্রহ যেমন চোখে লাগে, তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহও তেমনি চোখে লাগে। তিনি নানান রকম লিষ্ট করতে লাগলেন। সময়ে-অসময়ে নীলুর সঙ্গে বসে পরামর্শ-এ হারিকেন নিতে হবে, বুঝলে বৌমা। এটা খুবই দরকার।
ওখানে নিশ্চয়ই হারিকেন আছে, বাবা।
তা তো আছেই। হয়তো একটা, বড়জোর দুটা। এতগুলি মানুষ আমরা যাচ্ছি। দুটা হারিকেনে আমাদের কী হবে বল? টর্চ লাইট নিতে হবে, মোমবাতি নিতে হবে। একটা কেরোসিনের চুলাও নেওয়া দরকার। ধরা চট করে এক কাপ চা খাবার দরকার হল, কোথায় পাবে? সেখানে তো আর গ্যাসের চুলা নেই। কী বল মা?
তা তো বটেই।
তুমি জহির আর শাহানাকেও বল। ওদেরকে নিয়ে যাই।
জ্বি, তাদেরও বলব। টুনির বাবার ছুটি হয়। কিনা এখনও বুঝতে পারছি না। ছুটি হলেই বলব।
না-না, তুমি মা আগে থেকেই বল।
শাহানা বেড়াতে যাবার কথায় ঠোঁট উল্টে বলল, তোমাদের ব্যাপার তোমরা যাও, আমাকে টানছ কেন?
নীলু বিস্মিত হয়ে বলার, আমাদের ব্যাপার মানে? তুমি কি আমাদের কেউ নাও?
না ভাবী। আমি তোমাদের কেউ না।
ও, তাই নাকি? আমি অবশ্যি এটা আগে জানতাম না। এখন জানলাম। না হয় তুমি বাইরের গেস্ট হিসেবেই আমাদের সঙ্গে চল। বাইরের গেস্টও কিছু যাচ্ছে।
বাইরের কে যাচ্ছে?
আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে বীণা।
আনিস ভাই যাচ্ছে না?
না।
দুনিয়াসুদ্ধ লোককে তোমরা নিচ্ছ, তাকে নিচ্ছ না কেন? সে কী দোষ করল? বলেছিলে তাকে?
নীলু গম্ভীর মুখে বলল, না।
বল নি কেন? এটা তো ভাবী সাধারণ ভদ্রতা। একবাড়িতে থাকে, দিনরাত এটা-ওটা ফরমাস খেটে দেয়। আর…
শাহানা কথা শেষ করল না। নীলুর কঠিন চোখের সামনে থতমত খেয়ে গেল। নীলু কড়া গলায় বলল, ঐ চিন্তা এখনও মাথায় নিয়ে ঘুরছ?
শাহানা টেনে–টেনে বলল, কোন চিন্তা?
তুমি ভালোই জান, কোন চিন্তা। অনেক তো হল শাহানা, আর কেন?
তুমি কী বলছি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না ভাবী। আমি শুধু বলছি-ভদ্রতা করে হলেও তোমার উচিত ছিল আনিস ভাইকে বলা। সবাই যখন যাচ্ছে।
আনিস এ বাড়িতে এখন থাকে না। থাকলে নিশ্চয়ই বলতাম।
আনিস ভাই তাহলে থাকে কোথায়?
আমি জানি না।
সে কী কথা ভাবী, তুমি জান না কেন?
আমাকে কিছু বলে যায় নি, কাজেই আমি জানি না।
শাহানাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। নীলুর বিরক্তির সীমা রইল না। এসব কী শুরু করেছে। শাহানা?
আনিসকে নিয়ে বাড়াবাড়িটাই তার অসহ্য লাগছে। নীলুর কেন জানি মনে হচ্ছে, এই বাড়াবাড়ি খানিকটা লোক দেখানো।
নীলু বলল, আমি এখন উঠব। শাহানা, তুমি জহিরকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে গেলে আমাদের ভালো লাগত।
শুধু তোমাদের ভালো লাগলে তো হবে না, আমারও ভালো লাগতে হবে। আমার ভালো লাগবে না।
কী করে ভালো লাগবে না?
জানি না। কী করে বুঝলাম।
নীলুউঠে দাঁড়াল। শাহানার এখানে এসে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। অনেক রকম ঝামেলা করে আসা। অফিস থেকে এই কারণে তাকে ছুটি নিতে হয়েছে। ভেবেছিল প্রথম আসবে শাহানাদের বাড়ি, সেখানে থেকে যাবে শারমিনদের বাড়িতে। কিন্তু এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। নীলু অবাক হয়ে লক্ষ করল, শাহানা দোতলা থেকে নিচে নামল না। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে ভাবী, পরে দেখা হবে। সময় পেলে আবার এস। অবশ্যি যদি তোমার ইচ্ছা করে।
গেটের কাছে জহিরের গাড়ি। ড্রাইভার বলল, আপনি এসেছেন শুনে স্যার পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেখানে–যেখানে যাবেন, নিয়ে যাব। নীলু বলল, আমার গাড়ি লাগবে না, রিকশা নিয়ে চলে যাব।
স্যার তাহলে খুব রাগ করবেন। আপা আসেন।
বাসায় ফিরে দেখে বসার ঘরে আনিস। জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। নীলু কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছা করছে খুব কড়া-কড়া কিছু কথা
ভাবী, ভালো আছেন?
হ্যাঁ, ভালো।
আমার নামে কি কোনো চিঠি এসেছে ভাবী?
না, কোনো চিঠিফিঠি আসে নি।
যদি আসে একটু রেখে দেবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে, রাখব।
ভাবী, আপনার কি শরীর খারাপ?
শরীর ঠিকই আছে। তুমি এখন যাও। আমি শুয়ে থাকব। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
আনিস ইতস্তত করে বলল, ভাবী, আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবেন–শ দুই?
নীলু ঠাণ্ডা গলায় বলল, এখন আমার কাছে টাকা পয়সা নেই।
আনিস চলে গেল। সে প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছে। ঘর থেকে বেরুবার সময় দরজায় একটা ধাক্কা খেল। হাঁটতে গিয়ে লক্ষ করল। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। সে ভেবেই পেল না, নীলু ভাবীর মতো মানুষ তার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার কেন করলেন? তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলাতে না-পারলে টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়বে। রাস্তার লোকেরা হী করে তাকিয়ে থাকবে। রাস্তায় নামবার আগে যে করেই হোক নিজেকে সামলাতে হবে। সে নিঃশব্দে ছাদে উঠে গেল।