কল্যাণীয়াসু নীলু/
আশা করি সবাইকে নিয়ে তুমি তোমার স্বভাবমতো ভালো আছ। কদিন থেকেই ভাবছি। এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে তোমাকে লিখব। বাবলুপ্রসঙ্গে যাতে কোনো দুশ্চিন্তা করতে না পার।
বাবলু ভালো আছে এবং বলা যেতে পারে সুখে আছে। গ্রাম তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে। খোলা মাঠ, নদী, বনজঙ্গল এসব তো সে কখনো দেখে নি। সে দেখেছে মানুষ-মানুষের মধ্যে যে-সব খারাপ ব্যাপার আছে, সেইসব। মানুষের বাইরেও যে আরেকটি সুন্দর শান্ত জগৎ আছে, তা সে জানত না। এখন জানল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। বনের ভেতর থেকেও কয়েক বার তাকে লোক পাঠিয়ে খুঁজে আনতে হয়েছে। ও তার নিজের একটি পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে। সেই পৃথিবী থেকে তাকে সরিয়ে আনতে মন চাচ্ছে না। আমি তাকে এখানের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।
আমি জানি তুমি আমার নির্বুদ্ধিতায় হাসছ। আমি সামনে থাকলে হয়তো খুব কড়া-কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিতে, তবু তুমি একটু ভাবলেই বুঝবে, আমি যা করছি তার ফল শুভ হবার সম্ভাবনা আছে। আমি নিজেও এখানে থেকে গেলাম। নীলগঞ্জ স্কুলে একটা মাস্টারি জুটে গেছে। সুখী নীলগঞ্জের যে-কাজ শুরু হয়েছিল, তা শেষ করা যায়। কিনা তাও দেখছি। দূর থেকে যে-কাজটি অসম্ভব বলে মনে হত, এখন তেমন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
মজার ব্যাপার কী জানি, নীলগঞ্জের লোকজন কেন জানি আমাকে বেশ পছন্দ করছে। আমাকে আড়ালে ডাকে পাগলা মাস্টার। যদিও পাগলামির কিছুই আমি করছি না। নামটা আমার পছন্দ হয়েছে, কারণ এরা কবির মামাকেও পাগলা মাস্টার ডাকত। যে-কোনোভাবেই হোক, গ্রামের মানুষদের উপর আমি কিছুটা প্রভাব ফেলেছি বলে মনে হয়। গত শুক্রবারে বড়ো রকমের একটা গ্ৰাম্য বিবাদ হল। সবাই দল বেধে এল আমার কাছে। আমি যেন একটা মীমাংসা করে দিই। আমি যা বলব, তাই নাকি তারা শুনবে। আমার কী মনে হয়, জান? আমার মনে হয় ওরা আমার মধ্যে কবির মামার ছায়া দেখতে চায়। কিন্তু এত বড়ো যোগ্যতা কি আমার আছে? আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র মানুষ।
তোমরা কবির মামার কুলখানিতে কেন এলে না বল তো? শওকত পরপর দুদিন স্টেশনে কাটাল। কখন তোমরা আসা। এসে কস্টেই পড় কি না। তোমরা না-আসায় তার কষ্ট দেখে আমি কষ্ট পেয়েছি। চলে এসো না এক বার। দেখে যাও আমরা কেমন আছি। পিকনিক করতেও তো মানুষ আসে।
কবির মামা প্রসঙ্গে মজার কথা শোন। মাঝে-মাঝে দূর-দূর থেকে লোকজন আসে পীর সাহেবের কবর জিয়ারত করতে। পীর কে বুঝতে পারিছ তো? কবির মামা। কী মুশকিল বল দেখি এক জন নাস্তিক মানুষকে এরা মনে হয়। পীর বানিয়ে ছাড়বেই। দূর-দূর গ্রামের লোকজন মোমবাতি আগরবাতি। এইসব দিয়ে যায়। আজ থেকে পাঁচ বছর পর যদি দেখ, এখানে বিরাট মাজার শরিফ বসে গেছে, উরস হচ্ছে, এবং আমি সেই মাজার শরিফের প্রধান খাদেম-তাহলে অবাক হয়ো না। এদেশে সবই সম্ভব।
আচ্ছা নীলু, তোমার শরীর ভালো আছে তো? কোনো কারণে তোমার মনটন খারাপ না তো? পরশু রাতে স্বপ্নে দেখলাম, তুমি মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। স্বপ্ন স্বপ্নই। তবু কেমন যেন লাগছে। তুমি ভালো আছে এই খবর জানিও, যদি সময় পাও। যা ব্যস্ত থাক, সময় পাওয়ার কথা নয়। বিশাল এই চিঠি ফেদে নিজেই বিব্রত বোধ করছি। কিছু মনে করেন। ভালো থাক।
তোমার দুলাভাই সোভাহান।
পুনশ্চঃ বাবলুর আর একটি শিল্পকর্ম পাঠালাম। দুমাথাওয়ালা ছাগল।
নীলু তার দুলাভাইয়ের চিঠি বেশ কয়েক বার পড়ল। প্রথম পড়বার সময় লোকটিকে যতটা নির্বোধি মনে হচ্ছিল, এখন ততটা মনে হচ্ছে না। হয়তো— বা খুব গুছিয়ে লেখা চিঠির কারণে। এই লোকটি যে এত গুছিয়ে লিখতে পারে তা নীলু জানত না। চিঠির ভেতর খুব সহজ-সরল একটা ভঙ্গি ঢুকে গেছে। অথচ এই মানুষটির জীবন খুব সহজ-সরল নয়।
কোনো রকম আদর্শবাদ, মহৎ চিন্তা, উচ্চস্তরের ভাবালুতা নীলু তার মধ্যে কখনো দেখে নি। এই লোক হঠাৎ বদলে গিয়ে গ্রাম উন্নয়ন শুরু করবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। হয়তো দু দিন পরই দেখা যাবে গ্রাম আর তার ভালো লাগছে না। সব ছেড়েছুঁড়ে আবার অন্য কোথাও চলে যাবে। যাবার আগে বাবলুকে এ বাড়িতে ফেলে যাবে। মাস দুই পর চোরের মতো আসবে। দীন ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে থাকবে। তার কাপড়ের ব্যাগে থাকবে বাবলুর জন্যে আনা কোনো সস্তা খেলনা। অক্ষম বাবার ভালবাসা সেই খেলনায় থাকবে, কিন্তু তা বাবলুর মনোহরণ করবে না। আজকাল শিশুরাও সস্তা খেলনা এবং দামী খেলনার তফাতটা ভালোই বোঝে। Ꮡ
সন্ধ্যায় নীলুশফিককে চিঠি পড়তে দিল। শফিক হাই তুলে বলল, এত লম্বা চিঠি আমি পড়তে পারব না। বিষয়বস্তু কী আমাকে বল।
বিষয়বস্তু কিছু নেই। পড় না। কতক্ষণ আর লাগবে!
শফিক চিঠি শেষ করে আশ্চর্য হয়েই বলল, সুন্দর চিঠি তো।
নীলু বলল, কোন জিনিসটা সুন্দর?
ঘরোয়া ভঙ্গিটা। মনে হয়। ভদ্রলোক যেন গল্প করছেন। তোমরা এক কাজ কর না কেন—ঘুরে আস নীলগঞ্জ থেকে। কয়েকটা দিন কাটিয়ে আস।
নীলু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
টুনির ভালো লাগবে। গ্রামে গিয়ে নদী, বন, এইসব দেখবে। বেচারি এক-একা থাকে।
সত্যি যেতে বলছ?
হ্যাঁ, যাও। আমিও টলম্যানকে বলে দেখি, যদি ছুটি পাই। সম্ভাবনা অবশ্যি কম, তবু দু-একদিনের জন্যে হয়তো ছাড়বে।
সত্যি-সত্যি তুমি যাবে?
হ্যাঁ, মানে চেষ্টা করব। বিদেশে ছুটির দিনগুলিতে সবাই বাইরে-টাইরে যায়। আমাদের তো এসব বালাই নেই। কাল আমি টলম্যানের সঙ্গে কথা বলে দেখব, ব্যাটাকে ভেজানো যায় কি না।