শারমিন বলল, তাহলে হয়তো এ বাড়িতে আসতে লজ্জা পায়।
এ বাড়ির মেয়ে বিয়ে করতে লজ্জা নেই, এ বাড়িতে আসতে লজ্জা? অন্য কোনো ব্যাপার কি আছে?
তা আমি কী করে জানব বাবা? আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি! ওর কথা কী করে বলব?
তোর কথাই না হয় শুনি।
কোন কথাটা শুনতে চাও?
Are you happy?
আমি জানি না বাবা।
জানি না মানে?
সত্যি জানি না। আমার মনে হয়, আমার মধ্যে সুখী হবার তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। যারা সুখী হয়, তাদের মধ্যে সুখী হবার বীজ থাকে। জল-হাওয়া এবং ভালবাসায় সেই বীজ থেকে গাছ হয়।
এই পর্যন্ত বলেই শারমিন থেমে গেল। উঁচুদরের ফিলসফি হয়ে যাচ্ছে-খাবার টেবিলে যা মানাচ্ছে না। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে রহমান সাহেব বললেন, তোর শ্বশুরবাড়ির অন্য লোকদের সম্পর্কে বল।
কী বলব?
কে কেমন মানুষ।
জানতে চাও কেন?
পরিবেশটি কেমন জানতে চাচ্ছি।
পরিবেশ চমৎকার!
এককথায় সারছিস কেন? প্রত্যেকের সম্বন্ধে আলাদা করে বল।
এখন থাক বাবা।
থাকবে কেন? এখনি বল। তোর শ্বশুর সাহেব কেমন মানুষ?
ঐ বাড়ির সবচে ভালো মানুষ। পাগলা ধরনের কিছু লোক থাকে না। বৈাবা, যারা মনে করে পৃথিবী খুবই সুন্দর জায়গা? উনি সেই রকম একজন মানুষ। খুব সুখী মানুষ। এবং তাঁর ধারণা, পৃথিবীর সবাই তাঁর মতো সুখী।
আর তোর শাশুড়ি।
খিটখিটে ধরনের মহিলা। চেঁচামেচি না-করলে তাঁর ভালো লাগে না। অকারণে চেঁচান। কেউ তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না বলে আরো রেগে যান। তাঁর ধারণা, সবাই তাঁকে অগ্রাহ্য করছে। সংসারের কর্তৃত্ব তাঁর হাত থেকে চলে যাচ্ছে।
সংসারের কর্তৃত্ব কার কাছে?
ভাবীর কাছে। পুরো সংস্থার তাঁর মুঠোয়, অথচ আমার শাশুড়ি তা জানেন না। কারণ ভাবী যে কী চালাক, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। রোজ জিজ্ঞেস করবে–মা, আজ কী রান্না হবে? আমার শাশুড়ি হয়তো একটা কিছু বলবেন, কিন্তু রান্না হয়তো তার আগেই হয়ে গেছে। শুধু শ্বাশুড়কে খুশি করার জন্যে বলা।
মেয়েটার নাম কি যেন?
নীলু, নীলু ভাবী।
তোর সঙ্গে ভাব আছে?
ওনার সঙ্গে আমার খুব একটা ভাব নেই। উনি অতিরিক্ত রকমের বুদ্ধিমতী। এত বুদ্ধিমতী কাউকে আমার ভালো লাগে না। তবে তাঁর আমার কোনো অভিযোগ নেই।
মেয়েটি বুদ্ধিমতী, শুধু এই কারণেই তুই তাকে পছন্দ করিস না, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
অন্য কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া ওনাকে পছন্দ করি না, এই কথা কিন্তু আমি বলি নি। ওনাকে পছন্দ না-করে উপায় নেই।
মেয়েটির হাসবেণ্ড সম্পর্কে বল। শফিক বোধ হয় ছেলেটির নাম, তাই না?
হ্যাঁ। ওনার সঙ্গে আমার কথাই হয় না।
কেন?
উনি কথা খুব কম বলেন। বাবলু বলে একটা ছেলে ছিল, ওর সঙ্গে মাঝে-মাঝে কথা বলতেন। এখন বাবলু নেই, ওনারও মুখ বন্ধ।
দুভাই তা হলে দু রকম?
হ্যাঁ, উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। বাবা, আমি উঠি?
খাওয়া শেষ?
হ্যাঁ, শেষ।
শারমিন উঠে গেল। রহমান সাহেবের সঙ্গে বেশিক্ষণ বসতে তার ভালো লাগে না। একটা অস্বস্তি মনের উপর চাপ ফেলতে থাকে। মনে হয়, এই বুঝি বাবা তাদের দুজনকে নিয়ে এমন এক প্রশ্ন করবেন, যার জবাব দেওয়া যাবে না।
এই যে এক-একা বাগানে হাঁটছে, সে জানে রহমান সাহেব তাকে লক্ষ করছেন। হয়তো নিজেই বাগানে নেমে আসবেন।
আপা, চা।
কুদ্দুস এ বাড়ির নিয়মকানুন জানে না। চা খাবার জন্যে শারমিনের আলাদা কাপ আছে। নিজের কাপ ছাড়া শারমিন খেতে পারে না। কুদ্দুস পেটমোটা একটা কাঁপে চা এনেছে। দেখেই রাগ লাগছে।
মিষ্টি হয়েছে। আপা?
হ্যাঁ হয়েছে, তুমি এখন যাও।
কুদ্দুস গেল না। দূর থেকে শারমিনকে লক্ষ করতে লাগল। শারমিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু ভালো লাগছে না। জীবন যদি নতুনভাবে শুরু করা যেত, তাহলে সে কী করত? রফিককে কি বিয়ে করত?
রহমান সাহেব নেমে এসেছেন। হাতের ইশারায় শারমিনকে ডাকছেন। শারমিন এগিয়ে গেল।
টেলিফোন এসেছে।
কে বাবা?
জিজ্ঞেস করি নি, মনে হচ্ছে রফিক।
শারমিন টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেল। হ্যাঁ, রফিকই-তবে গলার স্বরটা কেমন অন্য রকম। ঠাণ্ডা লেগেছে হয়তো।
হ্যালো, শারমিন?
হ্যাঁ।
সুখে আছ কিনা জানার জন্যে টেলিফোন করলাম।
তার মানে?
আছ কেমন?
ভালোই আছি।
বাড়ি ফিরে আসার কোনো পরিকল্পনা কি আছে?
বাড়িতেই তো আছি।
এই বাড়ি নয়, তোমার নিজের বাড়ির কথা বলছি।
শারমিন ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার তো মনে হয় এটা আমার নিজেরই বাড়ি, অন্য কারোর নয়।
আজকাল তাহলে জীবন সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছ।
যা বলতে চাও সহজ করে বল, এত পেঁচিও না। কী বলতে চাও তুমি?
কিছু বলতে চাই না।
বেশ, তাহলে টেলিফোন রেখে দিই।
তুমি কবে আসবে?
জানি না কবে আসব। ইচ্ছে হলেই আসব।
মনে হচ্ছে খুব সহজে ইচ্ছে হবে না।
শারমিন কথা বলল না। রফিক বলল, তোমার বিদেশীযাত্রার কত দূর?
বেশ অনেক দূর।
যাচ্ছেই। তাহলে?
সে তো তুমি জান। তোমাকে আগেই বলেছি।
আমার ইচ্ছা নয় তুমি যাও।
তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা এখানে উঠছে কেন? যাচ্ছি। তো আমি? তুমি তো যাচ্ছ না।
তোমার যাবার ব্যাপারে আমার কিছু বলার থাকবে না?
না, থাকবে না!
তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ, তুমি আমার স্ত্রী।
না, ভুলি নি। তুমি আমাকে ভুলতে দিচ্ছ না। সারাক্ষণই মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করছি।
মনে হচ্ছে ভূমি আমাকে ভুলে যেতে চাও?
শারমিন জবাব না-দিয়ে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। তার মনে হল সামনের সময়টা খুব খারাপ। এই সময় পার করা সহজ হবে না। সে নিঃশব্দে ছাদে উঠে গেল। নিজেকে খুব একা লাগছে। এ-রকম কখনো লাগে না। আজ মনে হচ্ছে এই বিরাট বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ নেই।
কল্যাণীয়াসু নীলু
নীলগঞ্জ থেকে সোভাহানের চিঠি এসেছে। দীর্ঘ চিঠি। নীলুর কাছে লেখা। চিঠি পড়ে নীলু হাসবে না। কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এই লোকটির নির্বুদ্ধিতার কোনো সীমা নেই। একটা মানুষ এতটা নির্বোধ হয় কেন? গুটিগুটি হরফে লিখেছে–