মনোয়ারা কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। রফিক বলল, ভাবী, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। খিদে লেগেছে।
এত দিন পর এলাম, প্রথম কথাটাই এই? কেমন ছিলাম, কী, জিজ্ঞেস করা। সাধারণ ভদ্রতাটা দেখাও।
কেমন ছিলে ভাবী?
প্রশ্ন করে রফিক উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না। বাথরুমে ঢুকে গেল।
রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে শফিক তার অভ্যাসমতো এক কাপ চা খেতে চাইল বলল, তোমার যাবার দরকার নেই। কাজের মেয়েটাকে বল ও দেবে।
আমিই বানিয়ে আনি।
নীলু রাতে শোবার আগে কখনো চা খায় না। আজ সে নিজের জন্যেও এক কাপ বানাল। শফিককে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে—দিতে বলল, তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?
রাগ করব কেন?
দু দিনের কথা বলে ছ দিন কাটিয়ে এলাম, এই জন্যে।
প্রয়োজন হয়েছে থেকেছ, এই নিয়ে রাগ করব কেন? তোমার কথা শুনে মনে হয়, আমার স্বভাব হচ্ছে অকারণে রাগ করা। আমি কি সে রকম?
না।
শফিক হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল, এক বার ভাবছিলাম তোমাকে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ টুনিকে নিয়ে চিটাগাং উপস্থিত হব। দেখব। তুমি কী কর।
এলে না কেন? তোমরা এলে আমার কত ভালো লাগত।
বলতে-বলতে কী যে হল, নীলু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। শফিক অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?
কী যে ব্যাপার, তা কি নীলু নিজেও জানে? আমরা আমাদের কতটুকুই-বা জানি?
শফিক আবার বলল, কী হয়েছে নীলু? তার গলার স্বর আশ্চর্য কোমল শোনাল। নীলু বলল, কিছু হয় নি, এস ঘুমুতে যাই।
বিছানার মাঝামাঝি টুনি শুয়ে আছে। নীলু নিজেই তাকে এক পাশে সরিয়ে দিল। সরিয়ে দিতে গিয়ে লক্ষ করল, টুনির বা চোখের নিচে ছোট একটা কালো বিন্দু উঁচু হয়ে আছে। নীলু বলল, ওর এখানে কী হয়েছে?
উলের কাঁটা দিয়ে খোঁচা লাগিয়েছে। আরেকটু হলে চোখে লাগত।
নীলুর গা দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। সে তার মেয়ের কপালে হাত রাখল। গা কেমন যেন গরম-গরম লাগছে। নীলু বলল, দেখ তো, ওর শরীরটা কি গরম?
শফিক গা করল না। সহজ স্বরে বলল, এই ঠাণ্ডায় পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে ঘুরে জ্বরজারি হয়েছে আর কি। বাচ্চাদের মাঝে-মাঝে অসুখবিসুখ হওয়া ভালো-এতে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়।
কে বলেছে তোমাকে?
কেউ বলেনি। কোথায় যেন পড়েছি।
এস, ঘুমুতে এস। নীলু আবার মেয়ের কপালে হাত রাখল। গা গরম। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাচ্চাদের জ্বরজারি সব সময়ই হয়। কত বার এমন হয়েছে, কিন্তু আজ নীলুর এ-রকম লাগছে কেন?
শারমিন বিকেলে বাগানে হাঁটছিল
শারমিন বিকেলে বাগানে হাঁটছিল।
তার গায়ে আকাশী রঙের একটা চাদর। এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে বলে চোখ-মুখ ফোলা-ফোলা। তার দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই। আজ কেন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠলে মন কেমন করে। অজানা এক ধরনের কষ্ট হয়। কেন হয় কে জানে।
সে হাঁটতে-হাঁটতে কুল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। পেকে সব টসটস করছে। খাওয়ার মানুষ নেই।
আপা, বরই পেড়ে দেই, খান।
না। তোমার নাম কী?
আমার নাম কুদ্দুস।
এই ছেলেটিকে সে আগে দেখে নি। সতের-আঠার বছর বয়স। দেখলে মনে হয়। কলেজে-টলেজে পড়ে। ঝকঝকে পরিষ্কার দাঁত। টুথপেস্ট্রের সুন্দর একটা বিজ্ঞাপন হয় একে দিয়ে।
কুদ্দুস, তুমি আমাকে চা খাওয়াতে পারবো?
এক্ষুণি আনছি আপা। বড়ো সাহেবের সঙ্গে চা খাবেন না?
বাবা কি বাসায় নাকি?
জ্বি, দোতলার বারান্দায়।
না, আমি বাগানে হাঁটতে-হাঁটতে চা খাব। তুমি এখানে নিয়ে এস।
চেয়ার দেই। আপা?
চেয়ার দিতে হবে না। হাঁটতে ভালো লাগছে।
ছেলেটি প্রায় দৌড়াতে-দৌড়াতে গেল। নতুন যারা আসে, প্রথম দিকে তাদের কাজের উৎসাহের কোনো সীমা থাকে না। কিছু দিন পার হলে উ ৎসাহে ভাঁটা পড়ে। তখন আর ডাকাডাকি করেও পাওয়া যায় না।
অবশ্যি এবার সবাই তার দিকে একটু বেশি নজর দিচ্ছে। কেউ-না-কেউ আশপাশে আছেই। এত যত্ব না-করলেই সে ভালো থাকত। নিজের মতো থাকতে ইচ্ছা করে। নিজের মতো থাকা সম্ভব হয় না।
মালী খুন্তি দিয়ে মাটি ঠিক করছিল। খুন্তি রেখে সে শারমিনের দিকে আসছে। সেও এখন দীর্ঘসময় ধরে নানান কথা বলবে। অপ্রয়োজনীয় অর্থহীন কথা।
গোলাপের গাছের কী অবস্থা হইছে দেখছেন আফা?
না, দেখি নি। কী অবস্থা?
ছোট ফুল। এক দিনের বেশি থাকে না।
এ-রকম হল কেন?
সেইটাই তো আফা বুঝি না। সার দেই। পোকা-মারা অষুধ দেই।
শারমিন চুপ করে রইল। মালী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মানুষজন বাগানে না-আসলে ফুল হয় না আফা।
তাই নাকি?
জ্বি আফা। মানুষের মায়া মুহাৰ্বত গাছ পছন্দ করে। যে—বাড়িতে দেখবেন মানুষজনে ভর্তি, সেই বাড়ির বাগানভর্তি ফুল। যে—বাড়িতে মানুষজন নাই, সেই বাড়িত ফুলও নাই।
বেশ মজা তো!
অখন আপনে আইছেন, দেখেন কেমুন ফুল ফোটে।
ঠিক আছে, দেখব।
কয় দিন থাকবেন, আফা?
শারমিন জবাব দিল না। সে কদিন থাকবে এটা নিয়ে সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। সরাসরি কিংবা একটু বাঁকা পথে। এ বাড়ির সবাই কিছু একটা সন্দেহ করছে। সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। এ বাড়িতে সে একা এসেছে। রফিক তার সুরে মুস নি। প্রায় ন দিন হয়ে গেল, এর মধ্যে এক বার দেখা করতেও अ८।
রহমান সাহেব ডাইনিং টেবিলে রফিকের প্রসঙ্গ এক বার তুলেছিলেন। শারমিন কোনো আগ্রহ দেখায় নি। ঠাণ্ডা স্বরে বলেছে, কাজটাজ নিয়ে থাকে, ऊांহা जीभ না।
রহমান সাহেব বললেন, এমন কোনো কাজ তো থাকার কথা নয়।