নীলু, অস্থির হয়ে পড়ল। অফিসের এই ঝামেলা তার সহ্য হচ্ছে না। সন্ধ্যাবেলা ডাকবাংলোয় ফিরে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। চলে যাবে।-সে উপায়ও নেই। তদন্তের দায়িত্ব তার উপর ক্রমে-ক্রমে চলে আসছে। দায়িত্ব অস্বীকার করার সাহস তার নেই।
রাতে তার ভালো ঘুম হয় না। এক রাতে ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখল—উলের কাঁটা নিয়ে টুনি খেলছে, হঠাৎ খোঁচা লাগল চোখে। রক্তারক্তি কাণ্ড! ডাক্তার এল এবং গম্ভীর মুখে বলল, একটা চোখে খোঁচা লাগলেও দুটি চোখেই নষ্ট। তবে চিন্তার কিছু নেই, পাথরের চোখ লাগিয়ে দেব। আসল, নকল কেউ বুঝতে পারবে না। নীলু স্বপ্নের মধ্যেই চেঁচিয়ে বলল, এসব আপনি কী বলছেন?
ডাক্তার তার দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, পাথরের চোখ আপনার পছন্দ না-হলে মার্বেল বসিয়ে দিতে পারি। মার্বেলেও খারাপ হবে না। অনেক রকমের রঙ আছে, আপনি নিজে পছন্দ করে নিতে পারেন।
ঘুম ভেঙে গেল। নীলুর গা দিয়ে টপটপ করে ঘােম পড়ছে। এ-রকম কু ৎসিত স্বপ্ন মানুষ দেখো! এ-রকম স্বপ্ন দেখার পরও কি কেউ বাসায় ফিরে না-গিয়ে থাকতে পারে? নীলুকে থাকতে হল।
ঢাকায় যেদিন রওনা হল, সেদিন তার মনে হল যেন কত দীর্ঘকাল বাইরে কাটিয়ে ফিরছে। ঢাকা পৌঁছেই দেখবে, সব বদলে গেছে। সবাইকে অচেনা-অচেনা লাগবে। টুনি সম্ভবত লজ্জা—লজ্জা মুখে পর্দার আড়ালে থাকবে। লজ্জা ভাঙতে সময় লাগবে। ইস, কতদিন যে সে মেয়েটাকে দেখে না।
কল্পনার সঙ্গে বাস্তব বোধহয় কখনোই মেলে না। নীলু, ঢাকায় পৌঁছল। বিকেলে। কিছুই বদলায় নি। সব আগের মতো আছে। টুনির হাতে একটা চকবার আইসক্রিম। আইসক্রিম তার জামা মাখামাখি হয়ে আছে। নীলু ভেবেছিল, তাকে দেখেই টুনি ছুটে আসবে, তা হল না। ঠিক সেই মুহুর্তে টুনির আইসক্রিমের একটা বড়ো অংশ ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। সে তার ভাঙা টুকরো সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কেমন আছ মা?
ভালো। তুমি আজ আসবে আমরা জানতাম।
কী ভাবে জানতে?
আবু টেলিফোন করেছিল।
তোমাদের আর সব খবর কী?
দাদীর একটা দাঁত পড়ে গেছে।
তাই নাকি?
হুঁ, দাদীকে পেত্নীর মতো লাগছে।
ছিঃ এসব বলতে নেই।
বললে কী হয়?
আল্লাহ পাপ দেন। কাছে আসমা, আমাকে একটু আদর দাও।
উঁহু, তোমার গায়ে আইস্ক্রিমের রস লেগে যাবে।
লাগুক। এস, আমাকে একটা চুমু দাও।
টুনি লজ্জিত মুখে মাকে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, জান মা, বাবলু এখনও আসে নি।
সে কী! কেন?
কী জানি।
বাসার আর সব লোকজন কোথায়? মনে হচ্ছে তুমি ছাড়া কেউ নেই।
বুয়া আছে। দাদা দাদীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। আব্বু অফিসে। চাচাও অফিসে।
তোমাকে একা ফেলে গেছে?
একা কোথায়, বুয়া তো আছে।
নীলু গোসল করতে ঢুকল। টুনিকে বলল দরজারপাশে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে। টুনি বলল, কেন মা? নীলু হেসে বলল, অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা তো, তাই। তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে।
আমি খুব সুন্দর করে কথা বলা শিখেছি, তাই না মা?
হ্যাঁ।
বাবলু কি আমার মতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে?
না। সে তো কথাই বলে না।
ছোট চাচী কি আর আসবে না, মা?
নিশ্চয় আসবে।
বীণা খালার মা বলেছে আর আসবে না।
তাই বলেছে বুঝি?
হ্যাঁ।
গোসলের পানি কনকনে ঠাণ্ডা। তবু নীলু মাথায় মগের পর মগ ঠাণ্ডা পানি ঢালছে। বন্ধ দরজার ওপাশে টুনি দাঁড়িয়ে ছেলেমানুষি সব কথা বলছে। বড়ো ভালো লাগছে শুনতে।
তুমি আমার কথা ভেবেছিলে টুনি?
হ্যাঁ, ভেবেছি।
কেঁদেছিলে আমার জন্যে?
না।
কাঁদ নি কেন?
আমি বড়ো হয়েছি যে, তাই।
বড়োরা বুঝি কাঁদে না?
না।
বড়ো বড়ো মেয়েরা যখন বিয়ে করে বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তখন তো কাঁদে। কাঁদে না?
হ্যাঁ, কাঁদে।
তুমি কাঁদবে না?
হ্যাঁ, কাঁদব।
মনোয়ারা ফিরলেন সন্ধু্যা মেলাবার পর। নীলুকে দেখেও কিছু বললেন না। তাঁর মুখ গভীর। রাগী-রাগী চোখ। হোসেন সাহেবও কেমন যেন বিপর্যন্ত। নীলু বলল, ঝামেলায় এত দেরি হল মা। আপনারা ভালো ছিলেন তো?
তিনি জবাব না-দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। হোসেন সাহেব বললেন, আজ আর তোমার শাশুড়িকে কিছু জিজ্ঞেস করোনামা, জবাব পাবে না।
নীলু বিস্মিত হয়ে তাকাল। হোসেন সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার শাশুড়ির সামনের দুটা দাঁত ডাক্তার ফেলে দিয়েছেন। আগে পড়েছে একটা। বিশ্ৰী দেখাচ্ছে। তাকান যাচ্ছে না।
হোসেন সাহেবের মুখ করুণ হয়ে গেল। যেন তাঁর নিজেরই সামনের দুটি দাঁত নেই।
মেয়েদের সৌন্দর্যই হচ্ছে দাঁত, বুঝলে মা?
বাঁধিয়ে নিলেই হবে বাবা।
বাঁধান দাঁত কি আগের মতো হয়? তুমি ভালো ছিলে তো মা?
জ্বি, ভলোই ছিলাম।
তুমি দূরে থেকে বেঁচে গেছ, তোমার শাশুড়ি দাঁতের যন্ত্রণায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুরে সবার মাথাখারাপ করিয়ে দিয়েছে।
শফিক এবং রফিক দু জন একই সঙ্গে এল-রাত এগারটায়। নীলুর চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। তবু সে জেগে আছে। মনোয়ারাও জেগে। ডেনটিষ্ট যে তাঁকে কী পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে, এটা তিনি চতুৰ্থ বারের মতো বলছেন।
ব্যাটা গৰ্ধভ কিছুই জানে না। আমার মনে হয় নকল করে পাশ করেছে। অবশ্য না করেই দাঁত তুলে ফেলেছে।
বলেন কী মা!
মহা হারামজাদা। উল্টা আমাকে ধমক দেয়।
সে কি!
হ্যাঁ, বলে কি-আপনি শুধু-শুধু এত হৈচৈ করছেন কেন?
খুব অন্যায়!
আপনি শুয়ে পড়ুন মা। দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন।
মনোয়ারা ঘুমুতে যেতে রাজি নন। তিনি আজকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তাঁর দুই ছেলেকে না-শুনিয়ে ঘুমুতে যেতে রাজি নন। সেই সুযোগ তাঁর হল না। রফিক ঘরে ঢুকেই বলল, বাহ্মা, তোমাকে তো সুন্দর লাগছে! কেমন যেন ড্রাকুলার মতো দেখাচ্ছে।