বীণা উঠে দাঁড়াল। আনিসকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আনিস বীণার অদ্ভুত কথাবার্তায় কিছুই বুঝল না। বোঝার কথাও নয়। বীণা কখনো পরিষ্কার করে কিছু বলে না। অর্ধেক কথা বলে, অর্ধেক নিজের মধ্যে রেখে দেয়।
গত রাতে মার সঙ্গে তার বড়ো রকমের একটা ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার শুরুটা এরকম-রাতে ঘুমুতে যাবার আগে লতিফা একটা ছবি আঁচলে লুকিয়ে বীণার ঘরে ঢুকে নানান কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বীণা বলল, কী বলতে এসেছ বলে ফেল, আমি ঘুমুর। আঁচলে ওটা কী? কার ছবি?
লতিফা বললেন, ছেলেটার নাম ইমতিয়াজ। ইন্টানি ডাক্তার।
ইন্টার্নি ডাক্তারের ছবি আঁচলে নিয়ে ঘুরছ কেন?
কী জন্যে ঘুরছি, তুই ভালোই জানিস। এমন করে আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন? আমি তোর মা না?
মা, তুমি ছবি নিয়ে বিদেয় হও। এই ঘোড়ামুখী ছেলে আমার পছন্দ না! ছবি দেখলেই ইচ্ছা করে ব্যাটার গালে এ্যাকটা খামচি দিই।
লতিফা স্তম্ভিত। কী ধরনের কথাবার্তা বলছে মেয়ে! সামান্য ভদ্রতা, আদব-কায়দাও কি সে জানে না? অশিক্ষিত মুখ মেয়েও তো নয়। লতিফা হিসহিস করে বললেন, তোর সমস্যাটা কী, আমি জানি।
জানলে বল।
তোর গলার দড়ি বাঁধা আছে দু তলার ছাদে। ঐ দড়ি না। কাটলে তোর মুক্তি হবে না।
দাঁড়ি কেটে মুক্তি দিয়ে দাও। দেরি করছ, কেন?
তাই করব হারামজাদাকে লাথি দিয়ে বের করব।
গালাগালি করছ কেন?
গালাগালি করব না তো কী করব? কোলে নিয়ে বসে থাকব? হারামজাদ ছোটলোক। সকাল হোক, কানে ধরে বের করে দেব। ফুটপাতের ছোকরা, ফুটপাতে থাকবে। ভিক্ষা করবে।
সকাল হলে বের করে দেবো?
হ্যাঁ, দেবই তো।
বেশ, দাও।
বীণা হাই তুলল। মশারি ফেলতে-ফেলতে বলল, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার কী? এখনি বিদেয় করে দাও। অপ্রিয় কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই ভালো। তুমি মা দয়া করে এখন ওঠা। আমি এখন ঘুমুব।
লতিফ, উঠলেন। সেই রাতে তাঁর ঘুম হল না। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে লাগল। আনিস ছেলেটি শনিগ্রহের মতো এ বাড়িতে ঢুকেছে। বড়ো কোনো সর্বনাশ সে করবে, এটা তিনি অনুভব করছেন। যে করেই হোক একে বিদেয় করতে হবে। হাতে শ পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলা যায়-এখানে আমার কিছু অসুবিধা আছে, তুমি অন্য কোথাও যাও।
না, এ-রকম বলা ঠিক হবে না। অসুবিধা আছে বলার দরকার কী? কোনোই অসুবিধা নেই। বলতে হবে, ছাদের ঘরটা আমাদের দরকার, কাজেই তুমি কোনো মেসেটেসে গিয়ে ওঠ।
ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা গলায় বলতে হবে, যাতে সে বুঝতে পারে যে, এবার তাকে আসর ভেঙে উঠতে হবে।
লতিফা গভীর রাতে বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢাললেন। কপালের দু পাশের শিরা দপদপ করছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ঠাণ্ডা পানি ঢেলেও সে-যন্ত্রণার আরাম হল না। বসার ঘরে একা জেগে বসে রইলেন। আনিসকে কী করে অতি ভদ্রভাবে অথচ শক্ত ভাষায় বাড়ি ছাড়ার কথা বলা যায়, তাই ভাবতে লাগলেন।
তাঁকে কিছু বলতে হল না। বীণার কথাতেই কাজ হল। পরদিন সন্ধ্যাবেলা আনিস তার বিছানা ও সুটকেস গুছিয়ে বিদায় নিতে এল। লতিফাকে বলল, বীণা কোথায়, মামী?
পড়ছে।
ওকে একটু ডেকে দিন না।
পড়াশোনার মধ্যে ডাকাডাকি করলে ও খুব বিরক্ত হয়। যা বলাবার আমাকে বল, ওকে আমি বলে দেব।
আমি চলে যাচ্ছি মামী। অনেক দিন আপনাদের বিরক্ত করলাম।
লতিফা বিব্রত স্বরে বলল, না না, বিরক্ত কিসের? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছ, খুব ভালো কথা।
যদি অজান্তে কোনো অন্যায় করে থাকি, ক্ষমা করবেন। কিছু মনে রাখবেন না।
লতিফা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। অতি দ্রুত চিন্তা করেও এই ছেলেটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাঁড় করাতে পারলেন না। মামী, আপনি কি কোনো কারণে আমার উপর অসন্তুষ্ট?
না না, অসন্তুষ্ট হব কেন?
তাহলে যাই, মামী। স্নামালিকুম।
লতিফা প্রায় জিজ্ঞেস করে ফেলছিলেন-কোথায় যাচ্ছ? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন। বাড়তি খাতির দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যাক যেখানে ইচ্ছা। আবার উদয় না হলেই হল!
আনিস চলে গিয়েছে, এই খবর বীণা সহজভাবেই গ্রহণ করল। কখন গিয়েছে, যাবার সময় কী বলেছে, এইসব নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাল না। অবহেলার ভঙ্গি করে বলল, গিয়েছে, ভালো হয়েছে। আপদ বিদেয় হয়েছে। তুমি এখন এক কাজ কর তো মা, চিলেকোঠার ঘরটা আমাকে পরিষ্কার করে দাও।
লতিফা বিস্মিত হয়ে বললেন, ঐ ঘর দিয়ে তুই কী করবি?
ওখানে পড়াশোনা করব। ওটা হবে আমার রিডিং রুম, বেশ নিরিবিলি।
লতিফা আর কথা বাড়ালেন না। এই প্রসঙ্গ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করার কোনো দরকার নেই। চাপা পড়ে থাকুক। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল।
নীলুচিটাগাং গিয়েছিল দু দিনের জন্যে। তাকে থাকতে হল ছ দিন। অফিসের কাজকর্মে এমন এক জট তারা পাকিয়ে রেখেছে, যা খোলার কোনো রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছত্রিশ লক্ষ টাকার হিসেবে গরমিল। এক বার অডিট হওয়ার পর দ্বিতীয় বার অন্য একটি কোম্পানিকে দিয়ে অডিট করানো হল। তারা আবার সব ঠিকঠাক পেল। কোম্পানির একটি মাইক্রোবাস হরতালের দিন পুড়ে গেছে, এমন রিপোর্ট আছে। আবার গোপন চিঠিও আছে যে, বাসটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। রং বদলে সেটা এখন চিটাগাং-নাজিরহাট লাইনে টিপ দেয়। চিঠিতে চেসিস-এর নম্বর পর্যন্ত দেয়া।
অফিসে বিভিন্ন লোকের ইন্টারভু্যু নেওয়ার সময় মনে হয় কেউ সত্যি কথা বলছে না। এটাও বিশ্বাস্য নয়-এতগুলি লোকের সবাই মিথ্যা কথা বলবে কেন?