আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, সবাইকে মারে নাকি?
হ, মারে। থুক দেয়। খুব বজ্জাত।
বুড়ো ছানিপড়া চোখে তাকিয়ে আছে। যেভাবে তাকিয়ে আছে, তাতে মনে হচ্ছে কিছু একটা করে বসতে পারে।
তোমার দাদা ম্যাজিক জানে?
না। খালি মানুষের শইলে খুক দেয়। খুব বজ্জাত। আফনে যান গিয়া। আপনেরে থুক দিব।
আনিস একটু সরে দাঁড়াল। এ বুড়োর কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। এত দূর এসে চলে যেতেও মন সরছে না। আনিস অনুনয়ের স্বরে বলল, চাচামিয়া, হাতের কাজ কিছু জানেন?
বুড়ো কুৎসিত একটা গাল গিয়ে আনিসের দিকে সত্যি সত্যি থুথু ফেলল। অদ্ভুত নিশানা। সেই থুথু এসে পড়ল আনিসের প্যান্টে। ছোট মেয়েটা মজা পেয়েছে খুব। হাসতে—হাসতে ভেঙে পড়ছে। হাসি থামিয়ে বলল, আপনারে কইলাম না, বুড়া খুব বজ্জাত। বিশ্বাস হইল?
তোমার নাম কী খুকি?
ময়না।
স্কুলে পড়?
না।
বুড়ো আবার থুথু দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। আনিস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলে এল। শুধু শুধু এতগুলি টাকা নষ্ট হল। ঢাকায় ফিরে গেলেও সমস্যা হবে। যে দুটি বাচ্চাকে সে প্রাইভেট পড়ায়, তাদের মা কাটা-কাটা স্বরে কথা শোনাবেন-কোথায় ছিলেন এই ক দিন? বাচ্চাদের পরীক্ষার সময় আপনি যদি এ-রকম ড়ুব মারেন, তাহলে কীভাবে হবে? একটা কাজ কুরুদায়িত্ব নিয়ে করবেন না? আপনাকে তো রেগুলার বেতন দিচ্ছি না?
এইসব কথা অবশ্যি সে গায়ে মাখে না। কোনো কথাই আজকাল সে গায়ে মাখে না। কেউ যদি গায়ে থুথু ফেলে, তাও সে অগ্রাহ্য করতে পারে। এসব সহ্য হয়ে গেছে। তবে টুশনি দুটি চলে গেলে তার কষ্ট হবে। রাস্তায়-রাস্তায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতে হবে।
ঢাকায় ফেরবার পথে জাপানি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম কাওয়ানা। বাসে তিনি বসেছেন আনিসের পাশে। টেকনিক্যাল টিমের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিন বছর কাটিয়ে দেশে ফিরবেন। দেশে যাবার আগে বাংলাদেশ ঘুরতে বের হয়েছেন। হাসিখুশি ধরনের মানুষ। বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু দেখায় ত্ৰিশের মতো। ভালো বাংলা বলতে পারেন। শুধু ক্রিয়াপদগুলি একটু ওলট-পালট হয়ে যায়। আনিস এক জন ম্যাজিশিয়ান শুনে তিনি খুবই অবাক হলেন।
আপনি কি এক জন পেশাদার ম্যাজিশিয়ান?
শখের ম্যাজিশিয়ান। পেশাদার ম্যাজিশিয়ান হবার মতো সুযোগ নেই।
সুযোগ থাকলে হতেন?
হ্যাঁ, হতাম।
ম্যাজিকের ব্যাপারে আমার নিজেরও অগ্রহ। আমি দেশের একটা ম্যাজিক ক্লাবের সদস্য।
আপনি নিজে ম্যাজিক জানেন?
না, আমি জানি না, আমার দেখতে ভালো লাগে। আপনি কী ধরনের ম্যাজিক দেখান? যন্ত্রনির্ভর?
জ্বি-না। যন্ত্রপাতি কোথায় পাব? বেশির ভাগই পামিংয়ের কৌশল।
পামিং কেমন জানেন?
ভালোই জানি।
এই সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে লুকাতে পারবেন?
হ্যাঁ, পারব।
আনিস মুহূর্তের মধ্যেই সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে ফেলল। প্রথম ডান হাতে, সেখান থেকে অতি দ্রুত বা হাতে। বাঁ হাত থেকে আবার ডান হাতে। জাপানি ভদ্রলোক মুগ্ধ হয়ে দেখলেন। এতটা তিনি আশা করেন নি।
দয়া করে আরেক বার করুন।
আনিস দ্বিতীয় বার করল। বাসের অনেকেই কৌতূহলী হয়ে দেখছে। দুটি ছোট বাচ্চ উঠে এসেছে আনিসের কাছে। জাপানি ভদ্রলোক বললেন, অপূর্ব!
আমি এত চমৎকার পামিং এর আগে দেখি নি। পামিংয়ের কৌশলে সবচে ভালো খেলা আপনার কোনটি?
গোলাপ ফুলের একটি খেলা আমি দেখাই। শূন্য থেকে গোলাপ তৈরি করি। ঐটি চমৎকার খেলা।
কটি গোলাপ বের করতে পারেন?
গোটা দশেক পারি।
ভদ্রলোক আনিসের ঠিকানা রাখলেন। বললেন, আমি দেশে যাবার আগে অবশ্যই আপনার গোলাপের খেলা দেখে যাব।
ভদ্রলোক তাঁর কথা রাখলেননা, তবে কিছু দিন পর আনিস জাপান ইয়াং ম্যাজিশিয়ান সোসাইটির সম্পাদকের কাছ থেকে একটা চিঠি পেল। যার রক্তব্য হচ্ছে-তারা তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আনিসকে নিমন্ত্রণ করছে তার গোলাপের খেলা দেখানোর জন্যে। আনিসের যাওয়া-আসার খরচ এবং এক সপ্তাহ জাপানে থাকার খরচ সোসাইটি বহন করবে। আনিসের সম্মতি পেলেই তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আনিস দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। কত আনন্দের খবর। কিন্তু এমন কষ্ট হচ্ছে কেন? সত্যি সত্যি তার চোখে পানি এসে গেছে।
পৃথিবী বড়োই রহস্যময়। সে যদি ইনাম শেখ বলে এক বুড়োর খোঁজে না যেত, তাহলে হৃদয়বান ঐ জাপানি ভদ্রলোকের সাথে তার দেখা হত না। এই যোগাযোগের পেছনে কারোর অদৃশ্য হাত সত্যি কি আছে? কেউ কি আড়ালে বসে লক্ষ করছে আমাদের? অসীম করুণাময় কেউ?
টুকটুক করে দরজায় টোকা পড়ছে। শাহানা যেমন করে টোকা দিত। আনিস বলল, কে? বীণা বলল, আমি।
আনিস দরজা খুলল। বীণার মুখ গভীর। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই সে কেঁদেছে, চোখ ফোলা-ফোলা।
কী খবর বীণা?
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসতে দিন।
আনিস সরে দাঁড়াল। বীণা ভেতরে ঢুকল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসল। আনিস বলল, কী হয়েছে বল তো?
আপনাকে কি মা কিছু বলেছেন?
না, কিছু বলেননি।
সত্যি করে বলুন।
সত্যি বলছি।
মা কিছুই বলেন নি?
না।
আনিস ভাই, আপনি এই বাসা ছেড়ে চলে যান।
আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাব?
জানি না কোথায় যাবেন! মোটকথা, আপনি এখানে থাকবেন না। কাল ভোরে যেন আপনাকে আর না দেখি।
কী হয়েছে বল তো বীণা।
কিছু হয়নি। কাল ভোরে চলে যাবেন।
আমার যাবার তো কোনো জায়গা নেই।
জায়গা না-থাকলে রাস্তায় থাকবেন। ফুটপাতে ঘুমুবেন। এই শহরে হাজার হাজার লোক ফুটপাতে ঘুমায়। আপনিও ঘুমুবেন। যখন খাওয়া জুটবে না, ভিক্ষা করবেন। .