নীলুর মা বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে মা। এ-রকম আর হবে না।
নীলুর দাদী সেদিন ভাত খেলেন না। সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। নীলুর মা অনেক কান্নাকাটি করে হাত-পা ধরে তাঁর রাগ ভাঙলেন।
সংসারে দাদী-নানীরা এরকম হবেন। টুনির দাদীর মতো মুখ কুঁচকে বলবেন না-মেরেছ বেশ করেছ। ভালো করেছ। শুধু যন্ত্রণা করে।
নীলুর মনে হল, চাকরি করতে গিয়ে সে অফিসের সঙ্গে বড়ো বেশি জড়িয়ে পড়েছে। অবহেলা করছে তার মেয়েকে। মারা বাচ্চাদের হাত ধরে–ধরে স্কুলে নিয়ে যান, ফিরিয়ে আনেন। সারা পথে বাচ্চারা মনের আনন্দে বুড়ি ঘুরে মার সঙ্গে। স্কুলের গল্প, বন্ধুবান্ধবদের গল্প। টুনির সে সুযোগ নেই।
নীলু ঠিক করল, আজ অফিসে দেরি করে যাবে। টুনীকে নিজেই স্কুলে পৌঁছে দেবে। বিকেলে তাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাবে। কয়েকটা গল্পের বই, একটা ফুলব্যাগ, এক বাক্স ভালো চকলেট। বাবলু না-থাকায় মেয়েটা খুব একা হয়ে গেছে। মামার কুলখানি তো কবেই হয়েছে, এখনও তারা আসছে না কেন, কে জানে। দুলাভাই মানুষটা কাণ্ডজ্ঞানহীন, কে জানে হয়তো নীলগঞ্জেই খুঁটি গেড়ে বসে গেছে। ছেলের স্কুলের কী হবে, কিছুই ভাবছে না।
টুনি তার মার সঙ্গে স্কুলে যাবার কোনো আগ্রহ দেখাল না। কঠিন মুখে বলল, আমি তোমার সঙ্গে স্কুলে যাব না।
কেন, আমি কী দোষ করেছি?
আমি যাব না।
দু জনে গল্প করতে—করতে যাব।
বললাম তো যাব না।
বিকেলে তোমাকে নতুন স্কুলব্যাগ কিনে দেব।
না না না।
তুমি খুব অবাধ্য হয়েছ টুনী।
হয়েছি, ভালো করেছি।
মনোয়ার ভেতর থেকে বললেন, বৌমা, একটু চড় দাও! তেজ বেশি হয়ে গেছে। তেজ কমুক।
নীলু অফিসে চলে গেল। তার মন বিষন্ন। মেয়েটা অনেকটা দূরে সরে গেছে, সে বুঝতে পারেনি। আজ মেয়েটাকে নিয়ে বেরুতে হবে। সারা সন্ধ্যা ঘুরবে।
অফিসে পৌঁছতেই শরিফ সাহেব বললেন, আপা, আপনাকে বড়ো সাহেব আর্জেন্ট মেসেহ দিয়ে রেখেছেন। আপনি যেন আসামাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। খুব জরুরি।
ব্যাপার কী?
আপনাকে চিটাগাং যেতে হবে।
কেন?
আছে অনেক ব্যাপার।
কবে যেতে হবে?
আজ দুপুরের মধ্যেই রওনা হতে হবে।
সে কি!
বড়ো সাহেব নিজেও যাবেন, আমিও যাচ্ছি। দু দিনের মামলা। কোম্পানির মাইক্রোবাস যাবে।
নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। দুপুরে রওনা হতে হলে হাতে একেবারেই সময় নেই। বাসায় যেতে হবে। জিনিসপত্র গোছগাছ করতে হবে। শফিককে খবর দিতে হবে। আচ্ছা, টুনিকে সঙ্গে নিয়ে গেলে হয় না? না, তা কি আর হয়! সে থাকবে অফিসের কাজে ব্যস্ত, টুনি গিয়ে কী করবে? কী বিশ্ৰী ঝামেলা।
নীলু রওনা হল একটার সময়। সে শফিকের সঙ্গে দেখা করে গেল। কিন্তু টুনির সঙ্গে দেখা হল না, টুনির পড়ার টেবিলে একটা চিঠি লিখে গেল–
মা গো, আমার দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটামাত্র মেয়ে। সেই মেয়ে যদি আমার উপর রাগ করে, তাহলে আমার খুব কষ্ট হয়।
আনিস গিয়েছিল দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে
আনিস গিয়েছিল দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে। সেখানে হাত-সাফাইয়ের এক জন বড়ো ওস্তাদ থাকে। ঠিকানা জানা ছিল না। ষ্টার ফার্মেসির উল্টো দিকে তার বাসা। নাম-ইনাম শেখ।
সৃষ্টার ফার্মেসি নামে কোনো ফার্মেসির সন্ধ্যান পাওয়া গেল না। ইনাম শেখের নামও কেউ শোনে নি। এতগুলি টাকা খরচ করে আসা; আনিসের ইচ্ছা করছে ডাক ছেড়ে কাঁদে। যাদের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছে, তারা ভুল খবর দেবে এটা বিশ্বাস্য নয়। ইনাম শেখ আছে নিশ্চয়ই—কেউ খোঁজ জানে না। ম্যাজিশিয়ানদের খোঁজখবর কে আর রাখবো? এককালে মুগ্ধ ও বিস্মিত হবার জন্যে মানুষ ম্যাজিক দেখত। আজকাল মানুষকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করবার আয়োজনের কোনো অভাব নেই।
আনিস হাল ছাড়ল না। রিকসাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, চায়ের দোকানের মালিক, সিনেমা হলের গেট কিপার, সবাইকে জিজ্ঞেস করে, ভাই, আপনারা একটা খোঁজ দিতে পারেন? ইনাম শেখ। ম্যাজিক দেখায়। হাত-সাফাইয়ের খেলা জানে!
উত্তরে সবাই বলে, উনার বাসা কোথায়? মানুষের নির্বুদ্ধিতায় তার গা জ্বালা করে। বাসা কোথায় জানা থাকলে সে জনে-জনে জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে কেন? নিজেই তো উপস্থিত হত। সেখানে।
আনিস ঠিক করল, সে সব মিলিয়ে এক শ জনকে জিজ্ঞেস করবে। তারপর মাইক ভাড়া করে হারানো বিজ্ঞপ্তি দেবে-ভাইসব। ইনাম শেখ নামে এক জন ম্যাজিশিয়ানের সন্ধ্যানপ্রার্থী। বয়স পঞ্চাশ। মুখে দাড়ি আছে, রোগা, লম্বা। পরনে নীল লুঙ্গি।
আনিস অবশ্যি জানে না, ইনাম শেখের বয়স পঞ্চাশ কিনা। মুখে দাড়ি, রোগা, লম্বা এসব তার কল্পনা। দরিদ্র মানুষ এ-রকমই হয়।
শেষ পর্যন্ত মাইকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার দরকার হল না। ইনাম শেখকে পাওয়া গেল। বয়স ষাটের উপরে। দুটি চোখেই ছানি পড়েছে। চলাফেরার সামৰ্থ্য নেই। ছেলের বাড়িতে থাকে। ছেলে মোটর মেকানিক। বাসা মেয়েদের হাই স্কুলের পেছনে। দু কামরার একটা টিনের ঘর। চট দিয়ে ঘেরা বারন্দায় ইনাম শেখের জন্যে খাটিয়া পাতা। বিকট দুৰ্গন্ধ আসছে লোকটির গা থেকে। কিছুক্ষণ পরপরই সে প্রবল বেগে মাথা চুলকাচ্ছে এবং বিড়বিড় করে বলছে-শালার উকুন।
ঢাকা থেকে এক জন লোক তার কাছে হাত-সাফাইয়ের কাজ শিখতে এসেছে শুনে সে বলল, যা শালা, ভাগ।
বাড়ির ভেতর থেকে দশ-এগার বছরের একটি বালিকা বের হয়ে বলল, দাদার মাথা খারাপ। আপনে যান গিয়া। আপনেরোমারব।