রফিক বাসায় ফিরল রাত নটায়। তাকে দেখেই টুনি বলল, ছোট চাচী চলে গিয়েছে। রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় গেছে?
ওনার নিজের বাড়িতে। সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। মনে হয়। আর আসবে का!
রফিক গম্ভীর হয়ে গেল। রাত এগারটায় ম্যানেজার সাদেক আলি এসে ংশুমুখে বলল, স্যার, কাজটা হয় নি।
রফিক শান্ত স্বরে বলল, না হলে কী আর করা যাবে? আপনি আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। বাড়ি যান, বিশ্রাম করুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবেন।
সাদেক আলি মৃদুস্বরে বলল, ওরা স্যার আগেই অন্য পার্টির সঙ্গে সব ঠিকঠাক করে আমাকে বলেছে একটু আমোদ-আহল্লাদের ব্যাবস্থা করতে। বলেছে—আমাদের খুশি করে দিন, তারপর দেখুন। আপনাদের খুশি করতে পারি। কিনা।
ঠিক আছে বাদ দিন। যা হবার হয়েছে।
আমি বাদ দেব? বলেন কী স্যার? আমার নাম সাদেক আলি না? আমার সাথে মামদোবাজি করবে, আমি চুপ করে থাকব?
কী করবেন আপনি?
আমি যে কী পরিমাণ শয়তান, আপনি তা জানেন না স্যার।
সাদেক আলি সাহেব!
জ্বি?
কাজটা না-হওয়ায় আমি খুশিই হয়েছি। সামান্য একটা কাজের জন্যে আমি মেয়েমানুষ পাঠাব, এটা তো হয় না। আমি ভদ্রলোকের ছেলে। আমার বাবা জীবনে কোনো দিন মিথ্যা কথা বলেন নি। আমার এক মামা-কবির মামা, তিনি তাঁর নিজের জীবনটা দিয়ে দিয়েছিলেন অন্যের জন্যে। সাদেক আলি সাহেব, আমার সারাটা দিন খুব মনখারাপ ছিল। কাজটা হয় নি। শুনে মনটা ভালো হয়েছে।
আপনি তো স্যার ব্যবসা করতে পারবেন না!
বোধহয় পারব না। বসুন, এক কাপচা খেয়ে তারপর যান।
সাদেক আলি বলল, আপনার মন ভালো হয়েছে, খুব ভালো কথা। আমার মনটা এখনও খারাপ, ঐ শালাকে শিক্ষা দিতে না পারলে স্যার আমার মন ভালো হবে না। চা খাব না স্যার। আমি যাই। স্নামালিকুম।
নীলগঞ্জ থেকে বাবলুর একটা চিঠি
নীলগঞ্জ থেকে বাবলুর একটা চিঠি এসেছে। চিঠি কার কাছে লেখা বোঝা যাচ্ছে না, কারণ কোনো সম্বোধন নেই। চিঠির রক্তব্যও সার্বজনীন-এ আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? ইতি বাবলু। চিঠি যেমনই হোক চিঠির সঙ্গের শিল্পকর্মটি অসাধারণ-একটি তিন মাথাওয়ালা গরু, ঘাস খাচ্ছে। মনোয়ারা ছবি দেখে আঁৎকে উঠে বললেন-তোমাকে কত বার বলেছি বৌমা, ছোঁড়াটার মাথা খারাপ। তুমি তো বিশ্বাস কর না। দেখ একটা গরু এািকছে, মাথা তিনটা। নীলুহাসতে-হাসতে বলল, ছেলেমানুষ।
ছেলেমানুষ হলেই তিন মাথার গরু, আঁকতে হবে? ছিঃ ছি, কী ঘেন্নার কথা।
ছবি দেখে টুনি বেশ মন খারাপ করল। বাবলু যে ছবি আঁকতে পারে, তাই তার জানা ছিল না। তাও এমন সুন্দর ছবি, যা সবাই কত আগ্রহ নিয়ে দেখছে! টুনি তার মাকে ধরল, মা, গরু, আঁকা শিখিয়ে দাও।
নীলু বিরক্ত হয়ে বলল, গরু আঁকা আমি জানি না মা, তোমার দাদুর কাছে যাও।
না, তুমি শিখিয়ে দাও।
দেখছি না, আমি একটা চিঠি পড়ছি। কেন বিরক্ত করছি টুনি?
না, তুমি শিখিয়ে দেবে। তুমি…
নীলু মেয়ের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। টুনি ইদানীং খুব বিরক্ত করছে। যা এক বার বলবে, তা-ই করতে হবে। গত রাতেও তাই করেছে। রাতে খাবার টেবিলে বলে বসিল, পোলাও খাব মা। নীলু বলল, পোলাও তো রান্না হয় নি, খাবে কী করে?
এখন রাঁধ।
কী বলছ টুনি এখন পোলাও রাঁধব কি?
না, রাঁধতে হবে। এখনই রাঁধ।
কাল পোলাও হবে। এখন খেয়ে নাও!
তাহলে আমি খাব না। টুনী টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। কিছুতেই তাকে খেতে বসানো গেল না। ত্য-সত্যি রাত দশটায় রান্না চড়াতে হল। মনোয়ারা গজগজ করতে লাগলেন, একটা মাত্র বাচ্চা, এরকম তো করবেই। তিন-চারটা ভাইবোন থাকলে এমন হত না। কী আর করা যাবে? সবাই হয়েছে আধুনিক। একটামাত্র বাচ্চা। ছেলে হলেও একটা কথা ছিল, মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে।
কিছু দিন থেকেই মনোয়ারা এই লাইনে কথাবার্তা বলছেন। কথার সারমর্ম হচ্ছে, আরো ছেলেপুলে দরকার। বংশরক্ষার জন্যে হলেও ছেলে দরকার। তাছাড়া এক সন্তান সংসারে অলক্ষ্মী ডেকে আনে। এইসব কথাবার্তা হয় কাজের মেয়েটির সঙ্গে, কিন্তু উদ্দেশ্য নীলু সেদিন নীলু অফিসে যাবার সময় শুনল, মনোয়ারা কাজের মেয়েটিকে বলছেন, এক সন্তান সংসারে থাকলে কী হয় জানিস? এক-একা থাকে তো, কাজেই অলক্ষ্মীকে ডাকে। তখন অলক্ষ্মী এসে সংসারে ঢুকে পড়ে। আর অলক্ষ্মী এক বার সংসারে ঢুকলে উপায় আছে? সব ছারখার হয়ে যায়।
নীলু, শুনেও না-শোনার ভান করে। মাঝে মাঝে বড়ো বিরক্ত হয়। তাঁর শাশুড়ির মাথায় এক বার কোনো জিনিস ঢুকে পড়লে খুব মুশকিল। তিনি সেটা নিয়ে দিনের পর দিন কথা বলবেন। অন্যে কী ভাবছে না-ভাবছে তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবেন না। এ-রকম একচোখো হয় কীভাবে!
তবে টুনি যে বেশ নিঃসঙ্গ, তা নীলু বুঝতে পারে। :: জেদী হয়, টুনি যেমন হয়েছে। একটু আগে সে চড় খেয়েছে। চোখে আসে নি। মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু বলল, কী হল, এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি গরু, আঁকতে পারি না এক বার তো বললাম।
তুমি পার।
তুমি বললেই তো হবে না। আমাকে আঁকা জানতে হবে।
তুমি জান।
নীলু দ্বিতীয় চড়টা বসাল। টুনি এতেও কাঁদল না। কিছুক্ষণ চোখ বড়ো—বড়ো করে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। মনোয়ারা পুরো দৃশ্যটি দূর থেকে দেখছিলেন। তিনি বললেন, বেশ করেছ, ভালো করেছ। শুধু যন্ত্রণা করে।
নীলুর বেশ মন খারাপ হল। তার শাশুড়ি এ রকম কেন বলবেন? দাদু-নানুরা সংসারে থাকেন কেন? নীলু নিজে যখন টুনির মতো বয়েসী, তখন তার দাদী থাকতেন তাদের সঙ্গে। চোখে ভালো দেখতেন না। হাঁটাচলাতেও কষ্ট হত। অথচ কেউ যদি নীলুকে কড়া কোনো কথা বলেছে, উনি ছুটে এসে চিলের মতো ছোঁ দিয়ে নীলুকে নিয়ে গেছেন। আর কী রাগ! এক বার নীলু একটা কানের দুল হারিয়ে ফেলেছে। নীলুর মা তাকে খুব মার দিলেন। নীলুর দাদী এসে বললেন, বৌমা, তোমার এত সাহস! তুমি আমার সামনে মেয়েটাকে মারলে? কোনের দুল হারিয়েছে তো কী হয়েছে? জিনিস হারায় না? তুমি বুঝি সারা জীবনে কিছু হারাও নি?