রফিক বসে আছে চুপচাপ। গল্প তরতর করে এগুচ্ছে। মনে মনে গল্প লেখার কাজটা এত সহজ, তার ধারণা ছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে টেলিফোন ধরল।
হ্যালো।
স্যার, আমি সাদেক।
কী খবর সাদেক সাহেব?
হাজার পাঁচেক টাকা দরকার স্যার। আধা ঘণ্টার মধ্যে।
কেন?
ব্যাপার আছে স্যায়! একটা মেয়ে আসবে আপনার কাছে। তাকে টাকাটা দেবেন। নাম হচ্ছে নমিতা। নমিতা নাম বললেই টাকাটা দিয়ে দেবেন। আমি আসতে পারছি না। অন্য জোগাড়যন্ত্র করতে হচ্ছে।
ক্যাশ টাকা তো নেই।
ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়ে আসেন স্যার। যাবেন আর আসবেন। মেয়েটা যেন আবার না চলে যায়।
মেয়েটা কে?
তা দিয়ে আমাদের দরকার নেই। কাজ হওয়া দিয়ে কথা। বহু কস্টে একে জোগাড় করা হয়েছে।
ব্যাপারটা কী একটু বলুন।
একটা ঘরোয়া ধরনের পার্টির মতো হবে। ঐ সব পাটির শোভা দুজন মেয়ে যাবে শোভা হিসেবে। একজন হচ্ছে আমাদের কুসুম, অন্য জননমিতা। রাস্তার মেয়ে তো আর পাঠানো যায় না। সবটা নির্ভর করছে ওদের উপর। স্যার, আমি টেলিফোন রাখলাম, আপনি টাকাটার জোগাড় দেখেন।
নমিতা কোনো রকম কথা ছাড়া টাকাটা তার ব্যাগে তরল। কী মিষ্টি চেহারা মেয়েটির চোখ দুটি বিষন্ন। ছায়াময় চোখ বোধহয় একেই বলে। বড়ো বড়ো পল্লব ছায়া ফেলেছে চোখে। মেয়েটির গায়ে গাঢ় নীল রঙের একটা চাদর। এই নীল রঙের জন্যেই কি তাকে এত বিষণ্ণ দেখাচ্ছে?
নমিতা বলল, আমি আপনার অফিসে খানিকক্ষণ বসব। সাদেক আলি সাহেব এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।
বসুন।
উনি কি আমার ড্রেস সম্পর্কে কিছু বলেছেন?
না, কিছু বলে নি। যা পরে এসেছেন তাতেই আপনাকে খুব চমৎকার লাগছে। w
মেয়েটি এক পলক তাকালি রফিকের দিকে।
বরফের মতো শীতল চোখ। কোনো রকম আবেগ-উত্তেজনা সেখানে নেই। রফিকু বলল, আপনি কি চা খাবেন?
না।
আমি খাব। আমার সঙ্গে এক কাপ চা খান।
মেয়েটি হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। রফিক দু কাপ চা বানোল। এক কাপ রাখল মেয়েটির সামনে। সে এই চা ছুঁয়েও দেখল না। ক্লান্ত গলায় বলল, দুটা প্যারাসিটামল এনে দিতে পারেন?
এক্ষুণি এনেদিচ্ছি। যাব আর আসব।
আপনি নিজেই যাবেন?
মেয়েটি হেসে ফেলল। কী সুন্দর হাসি! রফিকের ইচ্ছা হল বলে-আপনার কোথাও যেতে হবে না। আপনি বাড়ি যান। আমরা অধিকাংশ কথাই বলতে পারি না।
শারমিন ছাদে একা-একা হাঁটছিল। এ বাড়ির ছাদে সে খুব কম আসে। কেন জানি তার ভালো লাগে না। ছাদে উঠলেই নিজেদের বাড়ির বিশাল ছাদের কথা মনে হয়। উঁচু রেলিংঘেরা ছোটখাট ফুটবল মাঠ। সেখানে যখন শারমিন গিয়ে দাঁড়াত, আশেপাশের কেউ তাকে দেখতে পেত না। কত সহজেই একা হওয়া যেত। এখানে সে সুযোগ নেই। চিলেকোঠার ঘরে থাকে আনিস। আশপাশের বাড়ির কয়েক জন ছেলেমেয়েও এখানে খেলতে আসে। চেঁচিয়ে মাথা ধরিয়ে দেয়।
আজ অবশ্যি কেউ নেই। আনিসের ঘর তালাবন্ধ। দরজার উপর একটা কাগজে বড়ো বড়ো করে লেখা-আমি এ সপ্তাহের জন্যে বাইরে গেলাম। সেই এক সপ্তাহ কবে শুরু হবে আকার কবেই—বা শেষ হবে, কে জানে। শারমিনের খুব ইচ্ছা করল ছোট ছোট করে লেখে—আপনার এই সপ্তাহ কবে থেকে শুরু।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। শারমিনের মন খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিল সন্ধ্যা মেলানোর আগ পর্যন্ত ছাদে থাকবে। সূর্য ডোবা দেখবে সেটা আর সম্ভব হল না। পৃথিবীটাই এমন, যারা একা থাকতে চায়, তারা একা থাকতে পারে না। রাজ্যের মানুষ এসে তাদের চারপাশে ভিড় করে।
শারমিন।
আরে ভাবী, তুমি!
নাও, চা নাও।
বুঝলে কী করে আমি ছাদে?
নীলু হাসতে বলল, আমি হচ্ছি মহিলা শার্লক হোমস। ছাদে কী করছ?
তেমন কিছু না। এবার শীত তেমন পড়ল না, তাই না ভাবী?
হুঁ। ফাল্গুন চলে এসেছে নাকি?
কী জানি। আমি এখন আর দিন-তারিখের হিসাব রাখি না।
শারমিন রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। নীল বলল, তোমার কী হয়েছে শারমিন, বল তো?
কই, কিছু হয় নি তো।
কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছ। রফিকের সঙ্গে কি কোনো কিছু নিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ?
না।
ও কী সব অফিস-টফিস খুলেছে, তুমি তো দেখতেও যাও নি!
যাব একদিন, দেখে আসব।
তুমি বাইরে চলে যাবে, এ-রকম একটা কথা শুনতে পাচ্ছি। এটা কি গুজব না। সত্যি?
সত্যি।
রফিক এক জায়গায়, তুমি এক জায়গায়?
হ্যাঁ।
এটা কি ভালো হবে?
শারমিন অল্প হাসল। খুব সহজেই সেই হাসি ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বলল, কত ছেলেই তো বৌকে ফেলে পি-এইচ.ডি. করতে যায়। আমি গেলে সেটা দোষের হবে কেন?
দোষের হবেনা। এখন তোমাদের দুজনেরই ভালোবাসাবাসির সময়। এ সময় আলাদা হওয়াটা ঠিক হবে না। তুমি আরো ভালো করে ভেবে দেখা।
দিন-রাতই ভাবছি।
বরং একটা কাজ কর, তুমি তোমাদের বাড়িতে গিয়ে থাক। একটা বৈচিত্ৰ্য আসুক। দিনের পর দিন এক জায়গায় থেকে তুমি হাঁপিয়ে উঠেছ। কিছুদিন ওখানে থাকলে তোমার ভালোলাগবে।
শারমিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও তাই ভাবছি ভাবী।
এত ভাবাভাবির কিছু নেই। বেশ কিছু দিন থেকে আসা। এখানে দিন-রাত কেমন গম্ভীর হয়ে থাক, আমার ভয়-ভয় লাগে। রফিকের না-छनेि না जवश्ा।
নীলু তরল গলায় হেসে উঠল। শারমিন বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় চলে গেলে কেমন হয় ভাবী।
আজই যাবে?
বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করলেই গাড়ি চলে আসবে। ভাবী, যাব?
বেশ তো, যাও। রফিককেও আমি পাঠিয়ে দেব।
নীলু লক্ষ করল শারমিনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দিনের শেষ আলো পড়েছে শারমিনের চুলে। চুলগুলি কেমন লালচে দেখাচ্ছে। সুন্দর লাগছে। শারমিনকে।