জহির বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
উনি কথা বলার সময় মুখ থেকে থুথু বের হয়। আমার গায়ে থুথু লেগে যায়।
নতুন এক জনকে রেখে দেব?
দাও।
তোমার উৎসাহ আছে তো, নাকি আমাকে খুশি করবার জন্যে। শাহানা উত্তর দিল না। দ্বিতীয় মাস্টারও এক সপ্তাহের বেশি টিকলেন না। উনি খুব সিগারেট খান। সিগারেটের গন্ধে শাহানার মাথা ধরে যায়। তৃতীয় এক জন এলেন। ইনি কী করছেন না-করছেন জহির জানে না। গান শেখার সময়টাতে সে থাকে না। শাহানা রেয়াজ করে। কিনা তাও জহিরের জানা নেই। রেয়াজ করতে তাকে সে কখনো শোনে নি। জহির গানটাকে দেখছে। সময় কাটানোর একটা পথ হিসেবে। কিছু একটা নিয়ে শাহানা ব্যস্ত থাকুক। মনের অস্থিরতা কমুক। কিন্তু তা কি সত্যিই কমছে?
রফিকের অফিস শুরু হয়েছে গত মাসের গোড়ায়।
শুরুর পনের দিন কিছু করার ছিল না। রফিকের কাজ ছিল সকালে এসে অফিসে বসে থাকা। দুপুরবেলা ঘন্টখানিকের জন্যে ছুটি। হোটেল থেকে খেয়ে এসে আবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একনাগাড়ে বসে থাকা। কথা বলার দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই, কারণ সাদেক আলি নানান জায়গায় ছোটাছুটি করছে। টাইপিস্ট হিসেবে একটি মেয়েকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। সেও আসছে না। সাদেক আলিকে এই প্রসঙ্গে কিছু বলতেই বিচিত্র একটা ভঙ্গি করে বলেছে, সময় হলেই সে আসবে। কাজ নেই কোনো, এসে করবেটা কী? রফিক বিস্মিত হয়ে বলেছে, কাজ না থাকলে অফিসে আসবে না?
আসবে স্যার, আসবে। ওর কাজ তো স্যার অফিসে না। কাজ অন্য জায়গায়।
তার মানে?
এইসব স্যার এখন আপনার জানার দরকার নেই। তাহলে খারাপ লাগবে।
রফিক আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছেও হয় নি। দু দিন মেয়েটির সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তার কাছে মনে হয়েছে বেশ ভালো মেয়ে। চেহারা ভালো, স্মার্ট। কথায়-কথায় হাসে, এবং বেশ রসিক। রফিকের দু-একটা রসিকতায় সে বেশ শব্দ করে হাসল। একটু গায়ে-পড়া ধরনের স্বভাব আছে। সেই স্বভাব রফিকের কাছে খুব খারাপ লাগে নি। প্রথম দিনেই সে রফিককে বলেছে, আমার ডাক নাম হল কুসুম। আপনি স্যার আমাকে কুসুম ডাকবেন। আমার ভালো নাম নিজের কাছেই সহ্য হয় না। অবশ্যি কুসুমও খুব বাজে নাম।
আপনি টাইপ কেমন জানেন?
কাজ চালাবার মতো জানি। এইসব অফিসে তো স্যার মিনিটে পঞ্চাশ ওয়ার্ড টাইপ করার দরকার নেই। সমস্ত দিনে হয়তো তিন থেকে চারটা চিঠি টাইপ করা হয়।
তাই নাকি?
জি স্যার। কাজকর্ম হয় টেলিফেনে এবং টেলেক্সে। এই জাতীয় কাজের সঙ্গে আমি অনেক দিন থেকেই আছি। সবই জানি।
অনেক দিন মানে কত দিন?
প্ৰায়ছ বছর।
আগের চাকরিটা ছাড়লেন কেন?
খাটুনি বেশি ছিল, সেই তুলনায় রোজগার ছিল না। নতুন ফার্মগুলিতে খাটুনি থাকে কম, রোজগার হয় বেশি। স্যার, আপনি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবেন।
কেন?
ছোট ফার্ম, সবাই বলতে গেলে ফ্যামিলি মেম্বারের মতো। তাই নয় কি স্যার?
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
এক-একা অফিসে বসে থাকার মতো যন্ত্রণা অন্য কিছুতেই নেই। টেলিফোন লাইন এসেছে গত সপ্তাহে। ইদরিসের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিছু সময় কাটছে। তবে ইদরিসও ব্যস্ত মানুষ। বকবক করার সময় কোথায় তারা? টেলিফোন করলেই দু-একটা কথা বলার পরই বলে, দোস্ত, তাহলে রাখলাম। রফিক সহজে রাখতে দেয় না।
ইদরিস, বসে থাকতে থাকতে তো শিকড় গজিয়ে গেল। কাজ-কর্ম কিছু নেই।
হবে দোস্ত, হবে। ধৈর্য ধর ধৈর্য ধরা-বাঁধ বাঁধ বুক।
আর কত ধৈৰ্য ধরব?
এইসব অফিসের কর্তাদের হতে হয় মাকড়সার মতো। জাল ফেলে লুকিয়ে বসে থাকতে হয়। জালে কিছু একটা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সুতো দিয়ে পেচিয়ে ফেলতে হয়। এক বার তো পড়েছিল, তুই তো পেঁচাতে পারলি না, অন্য পার্টি নিয়ে নিল। চিন্তা করিস না, আমি সাদেক আলিকে একটা বড়ো টিপস দিয়েছি। হতে পারে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, হবার সম্ভাবনা আশি ভাগ, তবে এইসব লাইনে কিছুই বলা যায় না। শেষ দেখবি ডাইস উল্টে গেল। রাখলাম দোস্ত!
ব্যাপারটা কী বল। কাজটা কী?
কাজ শুনে তুই করবিটা কী? বসে মাছি মারছিস, মাছি মার। যা করবার সাদেক আলি করবে। ও টাকা পয়সা যা চায়, সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিবি কী জন্যে চাচ্ছে, কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
রহস্যসয়া ব্যাপার মনে হচ্ছে!
রহস্য কিছু না। দোস্ত রাখলাম।
ইদরিসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে চার দিন আগে। এই চার দিনে কাজের অগ্রগতি কী হচ্ছে, রফিক কিছুই জানে না। সাদেক আলিকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে। তারও উপায় নেই। তার দেখাই পাওয়া যায় না।
আজ রফিক অফিসে এসে খুব বিরক্তি বোধ করল। গাদাখানিক ম্যাগাজিন জোগাড় করে রেখেছিল, অফিসে নিয়ে আসবে। পড়ে সময় কাটাবে। আসার সময় ভুলে ফেলে এসেছে। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। অফিসে কোনো লোকও নেই যাকে পাঠানো যাবে। রফিকের ইচ্ছা ছিল এক জন অফিস এ্যাসিসটেন্ট রাখার। সাদেক আলি রাজি হয় নি। দাঁত বের করে বলেছে, এখনো সময় হয় নি স্যার। সময় হলে সব হবে। অফিস এ্যাসিসটেন্ট হবে, পি.এ.হবে, ক্যাশিয়ার হবে, হেডক্লার্ক হবে। কয়টা দিন ধৈৰ্য্য ধরেন।
রফিক ধৈৰ্য ধরেই আছে। ধৈর্যেরও সীমা আছে। এখন একেবারে সীমা অতিক্রম করার মতো অবস্থা। রফিক ইলেকট্রিক হিটার বসিয়ে দিল। আপাতত চমৎকার জাপানি কাঁপে চা খাওয়া যাক। চা খেতে-খেতে জীবন সম্পর্কে কিছু ফিলসফিক চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। লেখার অভ্যাস থাকলে সময়টা কাজে লাগত। দারুণ রোমান্টিক একটা গল্প ফাদা যেত। যেখানে তিনটি মেয়ে ভালোবাসে একটি ছেলেকে। ছেলেটি আবার চতুর্থ একটি মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই মেয়ে বিবাহিতা। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। জটিল পঞ্চভুজ প্রেম। সবচে ভালো হয় নিজেকে নিয়ে গল্প শুরু করলে। ধনী বাবার কন্যা ভালবাসত প্রবাসী এক ছেলেকে। হঠাৎ কী মতিভ্রম হল, বিয়ে করে বসল। চালচুলো নেই এক বেকার যুবককে। সেই বেকার যুবক হচ্ছে এক জন আদর্শবান, অনুভূতিপ্রবণ, কোমলহৃদয় পুরুষ।