না, আমি আজ আর খাব না।
কেন?
শরীর ভালো লাগছে না, এই জন্যে খাব না। তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে নাকি?
নীলু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কোনো করণে তার শাশুড়ি রেগে আছেন, সে কারণটা ধরতে পারছে না।
তরকারি তো সবটাই ঢেলে ফেললে। রফিক খাবে কী?
ওকে একটা ডিম ভেজে দেবী মা। ছোট মাছ সে এমনিতেই পছন্দ করে না।
করুক আর না-করুক, একটা জিনিস রান্না হয়েছে, সেটা তাকে দেবে না? সে তো আর কাজের লোক না, এই বাড়িরই ছেলে। না, তুমি সেটা মনে করা না?
নীলু বড়ো লজ্জায় পড়ে গেল। মার গলা যেভাবে উঁচুতে উঠছে, তাতে মনে হয় খাবার ঘর থেকে সবাই শোনা যাচ্ছে।
হাগারের পাগারের লোকজন ধরে ধরে আনলে খাবার তো কম পড়বেই। এটা তো আর হোটেল না।
নীলু কী বলবে ভেবে পেল না। এখন কিছু বলা মানেই তাঁকে আরো রাগিয়ে দেওয়া।
শোন বৌমা, তোমাকে আরেকটা কথা বলি, শাহানা এখন বড়ো হয়েছে। কাউকে ডেকে আনার জন্যে রাত-দুপুরে তাকে ছাদে পাঠানো যায় না। বুঝতে পারছি?
পারছি।
নীলুর চোখে পানি এসে গেল। মনোয়ারা তাকিয়ে আছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। চোখের পানি তাঁকে বিন্দুমাত্রও নরম করতে পারল না। হোসেন সাহেব দরজায় এসে উঁকি দিলেন।
কই বৌমা, তরকারির কথা বলছিলাম।
আনছি, বাবা।
মনোয়ারা না খেয়েই ঘুমুতে গেলেন। খাওয়া নিয়ে তাঁকে পিড়াপিড়র সাহস নীলুর হল না। সে নিজেওঁ না খেয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বসে রইল রফিকের জন্যে। ইদানীং রফিক ফিরতে রোজ এগারটা-বারটা বাজাচ্ছে। নীলুকে বলা আছে খাবার ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু তাতে লাভ নেই—উঠে এসে দরজা তো খুলতেই হবে।
এখন সাড়ে বারটা বাজে। আজ বোধহয় আর আসবে না। নীলু ঘুমুতে গেল। বাবু কেমন দু হাত উপরে তুলে ঘুমাচ্ছে। কম্বল সরে গেছে গা থেকে। টুকটুকে ফর্সা পা বের হয়ে আছে। ফ্ল্যানেলের পায়জামা বানাতে হবে, যাতে কম্বল সরে গেলেও ঠাণ্ডা না লাগে।
নীলু, তোমার একটা চিঠি আছে, দিতে মনে ছিল না। দেখ টেবিলের উপর।
নীলু অবাক হয়ে বলল, তুমি জেগে ছিলে নাকি?
হুঁ।
বাবুর গা থেকে কম্বল সরে গেছে, তুলে দাও নি কেন?
শফিক কিছু বলল না। নীলু চিঠি নিয়ে আবার বসার ঘরে চলে এল। চিঠি মার কাছ থেকে এসেছে। কাজেই এই চিঠি পড়তে পড়তে অনেক বার চোখ ভিজে উঠবে। আড়ালে পড়াই ভালো। মা তার সব চিঠিই শফিকের ঠিকানায় পাঠান। হয়তো ভাবেন, এভাবে পাঠালে অন্য কেউ পড়বে না।
আমার মা-মনি,
মাগো, তোমার সোনামনিকে এখনও দেখিতে অ্যাসিতে পারলাম না। যত বার মনে হয় তত বার কষ্ট পাই। কি করিব মা, হাত-পা বাঁধা। বজলুর হাতে টাকা নাই। আসা-যাওয়ার খরচ আছে। এই দিকে বৌমাও অসুস্থ। ঘরে কাজের লোক নাই। সব কিছু আমাকেই দেখাশুনা করিতে হয়।
লক্ষ্মী মা আমার, রাগ করিও না। ফেব্রুয়ারি মাসে যেভাবি হউক আসিব। আর মা শোন, তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি যে নাম রাখিতে বলেন। সেই নামই রাখিও। তাঁহাদের অখুশি করিয়া কোনো কাজ করিও না। এই দিককার খবর ভালোই। বিলু বেড়াইতে আসিয়াছিল। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়া বৌমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হইয়াছে। দোষ বৌমার। মেয়েটা কয়েক দিন ভাইয়ের বাসায় থাকিতে চাহিয়াছিল, রাগারগির জন্য পারে। নাই। তুমি তাহাকে চিঠিপত্র দাও না কেন মা? মেয়েটা বড়ো দুঃখী। তাহাকে নিয়মিত চিঠি দিও।
বড়ো জামাইয়ের স্বভাব-চরিত্র আগের মতোই আছে। বিলুর সঙ্গে তাহার সম্পর্ক নাই বললেই চলে। বুঝিতে পারি না, আল্লাহ্ পাক কেন আমার জন্যই সমস্ত দুঃখ-কষ্টজমা করিয়া রাখিয়াছেন।
যাইহোক মা, তুমি এইসব নিয়া চিন্তা করিও না। জামাইয়ের যত্ন নিও। তোমার সোনার সংসারের কথা যখন ভাবি, তখন মনে বড়ো শান্তি পাই! তুমি বড়ো ভাগ্যবতী মা। আল্লাহর কাছে সবুর স্বীকার করিও। না হইলে আল্লাহ পাক নারাজ হইবেন।
সুদীর্ঘ চিঠি। নীলু চিঠি শেষ করে দীর্ঘ সময় একা একা বসে রইল। মাকে কিছু টাকা পাঠাতে পারলে হত। এই মাসে সম্ভব হবে না। শফিকের হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই।
সংসারের খরচ বেড়েছে, আয় বাড়ে নি। ক্রমে ক্রমেই শফিকের উপর চাপ বাড়ছে। এই চাপ আরো বাড়বে। সামনের দিনগুলি কেমন হবে কে জানে। গত মাসে সে নীলুকে হাতখরচের টাকা দেয় নি। লজ্জিত মুখে বলেছে, এই মাসে দিতে পারলাম না নীলু। এদিকে রফিক বলে রেখেছে-যেভাবেই হোক দুশ টাকা দিতে হবে ভাবী। নয়তো একেবারে বেইজ্জত হব।
প্রতি বৎসর শীতের সময় দেশের বাড়ি থেকে কিছু চাল আসে, এবার তাও আসে নি। কেন আসে নি কে জানে?
বাবু উঠে পড়েছে। প্রচণ্ড জোর তার গলায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে সবাইকে জাগিয়ে তুলবে। নীলু নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেল। মনোয়ারার ভেঙে গেছে—তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচাচ্ছেন, কী হয়েছে? ও বৌমা, হয়েছে?
রফিকের মনে ক্ষীণ আশা
রফিকের মনে ক্ষীণ আশা ছিল, শারমিনের আচার-আচরণে একটি পরিবর্তন লক্ষ করবে। বড়ো ধরনের কিছু না হলেও চোখে পড়বার মতো। পরিচিত ভঙ্গিতে একটু হাসবে কিংবা করিডোরে দেখা হয়ে গেলে বলবে।–কী, কেমন আছেন?
অথচ শারমিন আগে যেমন ছিল এখনো তেমন। গম্ভীর হয়ে ক্লাসে আসে। লেকচার শেষ হওয়ামাত্রই বিদায়। রফিকের আশা ছিল, ডিপার্টমেন্টাল পিকনিকে সে যাবে, তখন এক ফাঁকে কিছু কথাবার্তা বলা যাবে। কী ধরনের কথাবার্তা বলবে, তাও সে ভেবে রেখেছে। যেমন,