বন্যা। আবার হাসতে শুরু করল। হাসাতে-হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। নীলুতাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। বন্যা বলল, আমার হাসিরোগ হয়েছে, বুঝলি? গতকাল ভাবী আমাকে কালনাগিনী বলে গাল দিয়েছে। রাগ ওঠার বদলে আমার হাসি উঠে গেল। হাসি দেখে ভাবী মনে করল, আমি পাগল হয়ে গেছি। ভয়ে তার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। হিহিহি।
নীলু বলল, এই বন্যা। চুপ করতো।
তোরও কি ধারণা, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
না হলেও শিগগিরই হবে। তুই একটা চাকরি-টাকরি করা। কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাক।
হ্যাঁ, তাই করব।
বন্যা উঠে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, যাই রে নীলু কাল আবার আসব, টাকাটা জোগাড় করে রাখবি।
টাকা ফেরত দিতে হবে না।
তাহলে তো আরো ভাল।
নীলু বন্যাকে এগিয়ে দিতে গেল। তার খুবই খারাপ লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে বন্যার সঙ্গে চলে যেতে। দুজনে মিলে সারা দিন ঘুরে বেড়াতে পারে। বন্যার ঠিক এই মুহূর্তে এক জন বন্ধু দরকার। যে তাকে সাহস দেবে, ভরসা দেবে। মাঝে-মাঝে জীবন ভিন্ন খাতে বইতে থাকে, সব কেমন জট পাকিয়ে যায়-তখন এক জন প্রিয়জনকে কাছে থাকতে হয়।
নীলু, যাই রে।
কাল আসিস।
আসব। একটা কথা নীলু, আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমি যদি চাকরি না করতাম, যদি বাসায় থেকে বাচ্চার দেখাশোনা করতাম, তাহলে সে द5ऊ?
এখন আর এসব নিয়ে কেন ভাবছিস?
ভাবছি না তো! এমনি মনে হল, তাই বললাম।
আর ভাবিস না।
না, ভাবব না। বাচ্চাটার জন্যে বড়ো কষ্ট হয় নীলু ওর নাম রেখেছিলাম অভীক। নামটা সুন্দর না?
হ্যাঁ, সুন্দর।
নামের মানে বল তো?
নীলু তাকিয়ে রইল।
সারা দিন তার আর অফিসের কাজে মন বসল না। বন্যার মতো প্ৰাণময় মেয়ের আজ কী অবস্থা! কী কঠিন দুঃসময়! সন্তানের মৃত্যুর পুরো দায়ভাগ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার উপর। বন্যা নিজেও তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
নীলু ঠিক করল, আগামী কাল সে ছুটি নেবে। বন্যা এলেই তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে। দূরে কোথাও যাবে বেড়াতে। বোটানিক্যালে গার্ডেনে কিংবা বলধা গার্ডেনে। কোথায় যেন সে পড়েছিল, গাছপালা মানুষের বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে পারে।
বন্যা পর দিন এল না। অফিস চারটায় ছুটি হয় নীলু পাঁচটা পর্যন্ত তার জন্যে অপেক্ষা করল। অফিসের গাড়ি চলে গিয়েছে। সে এক-একা বাসায় রওনা হল। রিকশা নিতে ইচ্ছা করছে না। হাঁটতে ভালো লাগছে। সন্ধ্যা নামছে। সন্ধ্যার বিষণ্ণ আলোয় তার মন কেমন করতে থাকে। জগৎ-সাংসার তুচ্ছ মনে হয়।
নীলুর হাতব্যাগে এক হাজার টাকা। তার কেন যেন মনে হল, এই টাকা নিতে বন্যা কোনো দিনই আর আসবে না।
শাহানা অসময়ে শুয়ে আছে।
এখন বাজছে সন্ধ্যা সাতটা। অথচ শাহানা মশারি খাটিয়ে শুয়ে আছে। জহির বিস্মিত হয়ে, ঘুমুচ্ছ নাকি? শাহানা বলল, হ্যাঁ।
একটু মনে হয় সকাল—সকাল শুয়ে পড়লে?
ভালো লাগছে না। ভালো না-লাগলে শুয়ে পড়তে হয় নাকি?
কী করব তাহলে?
কত কিছু করার আছে-বই পড়, টিভি দেখ, তোমাদের বাসা থেকে বড়িয়ে আস, শপিং-এ যাও।
শাহানা তার মাথার উপর লেপ টেনে দিল। সে আর কোনো কথা-বার্তায় উৎসাহী নয়। এখন সে ঘুমুবে।
জহির বলল, শাহানা, বাতি নিভিয়ে দেব?
দাও।
রাতে কিছু খাবে না?
না।
আমার উপর কি কোনো কারণে রাগ করেছ? শাহানা জবাব না-দিয়ে পাশ ফিরল। এর মানে পরিষ্কার বোঝা গেল না। হয়তো রাগ করেছে। অনেক চিন্তা করেও রাগের কারণ কী, জহির বের করতে পারল না। সে বাতি নিভিয়ে বসার ঘরে চলে গেল। টিভি চলছে। পর্দায় নানান ছবি, কিন্তু শব্দ নেই। এও শাহানার কাণ্ড। সে সন্ধ্যা হতেই টিভি ছেড়ে সামনে বসে থাকে। শব্দ ছাড়া টিভি দেখে। এর কী মানে, কে জানে! চেনাজোনা কোনো সাইকিয়াটিষ্ট থাকলে আলাপ করা যেত। তেমন কেউ নেই। জহিরের মনে হয় যে-কোনো কারণেই হোক, শাহানার মন খুব বিক্ষিপ্ত। প্রচুর কাজে তাকে ড়ুবিয়ে রাখতে পারলে মানসিক এই অবস্থাটা হয়তো কাটত। তাও করা যাচ্ছে না। শাহানা আর পড়াশোনা করতে রাজি নয়। সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু ক্লাসে যাচ্ছে না। আর পড়াশোনা করবে না, এ-রকম একটা ঘোষণা গত সপ্তাহে দিয়েছে। জহির বলেছে, কোন পড়াশোনা করবে না?
ভালো লাগে না, তাই করব না।
সময় কাটবে কী করে?
যেভাবে কাটছে সেইভাবে কাটবে। আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবতে হবে না।
কেন ভাবতে হবে না?
জানি না। আমি এত সব প্রশ্নের উত্তর জানি না।
এই বলেই শাহানা উঠে গিয়ে শব্দহীন টিভির সামনে বসেছে। বসার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, পর্দার ছবিগুলির নড়াচড়া দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে। জহির এসে বসল। তার পাশেই! শাহানা তা যেন লক্ষই করল না। জহির বলল, সাউণ্ড দাও। বিনা শব্দের ছবিতে কী আছে?
শাহানা ক্লান্ত গলায় বলল, আমার এইভাবেই দেখতে ভালো লাগে।
শব্দ তোমার ভালো লাগে না?
না।
আগে লাগত? যখন তুমি তোমাদের বাড়িতে থাকতে?
জানি না। তোমাকে তো বলেছি, আমি এত সব প্রশ্নের উত্তর জানি না। জহির চুপ করে গেল। সে বুঝতে পারছে, তাদের দু জনের ভেতর দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এটাকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। কীভাবে দূরত্ব কমান যায় তাও তার জানা নেই। এক দিন সে বলল, গান শিখবে শাহানা? গানের মাস্টার রেখে দিই? শাহানা হাঁ-না কিছুই বলল না। গানের মাস্টার এক জন এলেন। হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার এল। হুঁলুস্কুল ব্যাপার। শাহানা দু দিন মাস্টারের কাছে বসে তৃতীয় দিনে বলল, ওনার কাছে গান শিখব না।