কুলখানির দিন রাতে শফিক হঠাৎ বলল, খুব অন্যায় হয়েছে নীলু আমাদের সবার যাওয়া উচিত ছিল। আমার খারাপ লাগছে!
এখন খারাপ লাগলেও তো কিছু করার নেই।
তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। নীলু, ছেলেবেলায় মামার কী পরিমাণ আদর যে আমরা পেয়েছি!
নীলু চুপ করে রইল। সে এ বাড়ির সবার উপর খুব বিরক্ত হয়েছে।
শফিক বলল, আজ অফিসে বসে ভাবছিলাম—কোনো দিন আমাকে আমরা কিছু দিই নি।
তিনি কিছু ফেরত পাবার আশায় নিশ্চয়ই তোমাদের ভালবাসেন নি?
কিন্তু আমাদের একটা দায়িত্ব ছিল।
হ্যাঁ ছিল।
এবার দেখলাম তাঁর স্যুয়েটারটা ছেঁড়া। আমি কি পারতাম না একটা নতুন স্যুয়েটার কিনে মামাকে বলতে-মামা, তোমার জন্যে এনেছি?
নিশ্চয়ই পারতে।
তাহলে কেন এটা বললাম না?
এখন আর এসব চিন্তা করে লাভ নেই। এস, শুয়ে পড়।
তারা বাতি নিভিয়ে দুজনই শুয়ে পড়ল। কিন্তু কেউই ঘুমুতে পারল না। রাত একটার দিকে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। প্রচণ্ড শব্দে তাদের দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল।
দরজা খুলে দেখা গেল-রফিক। সে থরথর করে কাঁপছে। শফিক বলল, কী হয়েছে রে?
রফিক কাঁপা গলায় বলল, সাংঘাতিক ভয় পেয়েছি। বসার ঘরে হঠাৎ দেখি কবির মামা বসে আছেন। আমাকে দেখে হাসলেন। আমি চিৎকার দিয়ে উঠতেই দেখি কেউ নেই।
দরজা খুলে সবাই বের হয়ে এসেছে। রফিক লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু তার ভয় এখনও কাটে নি। সে মৃদু গলায় বলল, আমি সত্যি দেখেছি, স্পষ্ট দেখলাম। মনের ভুল না।
নীলু বলল, তোমার মনে অপরাধবোধ কাজ করেছিল, তাই এসব দেখছি। যাও, শুয়ে পড়।
ভাবী, আমি সত্যি দেখেছি।
এস, তোমাকে চা বানিয়ে দিচ্ছি। চা খেয়ে ঘুমাও।
মনোয়ারা বললেন, চা না, ওকে এক গ্লাস লবণপানি দাও। এটা খাওয়া দরকার। দেখা না কেমন ঘামিছে।
রফিক ভালোই ভয় পেয়েছে, কারণ তার জ্বর এসে গেল। বেশ ভালো জ্বর-একশ দু পয়েন্ট পীচ। শারমিনকে অনেক রাত পর্যন্ত মাথায় পানি ঢালতে হল। রফিক ক্ষীণস্বরে বলল, কেমন ছেলেমানুষি কাণ্ড করলাম, বল তো। দিনের বেলা সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে।
করলে করবে, তুমি চুপ করে থাক।
আমি কিন্তু সত্যি দেখেছি। বিশ্বাস কর।
তুমি কিছুই দেখ নি। ভাবী যা বলেছে সেটাই সত্যি।
স্পষ্ট দেখলাম শারমিন। কমলা রঙের স্যুয়েটার গায়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
ঠিক আছে, থাক। এখন এসব গল্প করতে হবে না।
তোমার ভয় লাগছে?
না, ভয় লাগছে না। ভয় কেন লাগবে? তাঁকে যদি দেখেই থাক, তাতে ভয়ের কী?
রফিক জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। শারমিন অনেক দিন পর তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে গেল। রফিক বলল, ভয় পেয়ে একটা লাভ হয়েছে। তুমি কাছে এসেছী। কবির মামাকে ধন্যবাদ।
বসার ঘরে বাকি সবাই গোল হয়ে বসে আছে। তাদের কেউই সেই রাতে ঘুমুল না। সবাই যেন কবির মামার উপস্থিতি অনুভব করছে। যেন এক্ষুণি ছায়াময় কোনো জগৎ থেকে তিনি দৃশ্যমান হবেন। এক সময় ভোর হল। গাছে গাছে পাখি ডাকতে লাগল।
নীলু হা করে তাকিয়ে আছে
নীলু হা করে তাকিয়ে আছে। তার চোখে গভীর বিস্ময়।
কি রে, এমন করে দেখছিস কেন? চিনতে পারছিস না?
পারছি, পারব না কেন? তোর এ কী হাল হয়েছে।
বন্যা হাসল। হাসি আর থামেই না। আশপাশের সবাই তাকাচ্ছে। অফিসে এসে কেউ এমন করে হাসে? নীলু বলল, এ্যাই, তোর কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
এত হাসছিস কেন?
জানি না কেন হাসছি। পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছি বোধহয়। তুই আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?
নীলু বন্যাকে ক্যান্টিনে দিয়ে গেল। তার মনে হল বন্যা ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়। চেহারা ভীষণ খারাপ হয়েছে। মাথার সামনের দিকের চুল উঠে কপাল অনেক বড়ো বড়ো লাগছে। শাড়িতে ইন্ত্রি নেই। ইন্ত্রি-ছাড়া শাড়িতে বন্যাকে কল্পনাও করা যায় না। নীলু বলল, তোর কী হয়েছে বল তো?
কিছুই হয় নি।
চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস?
হুঁ, সে তো এক বছর আগে। তুই কোনো খোঁজখবর নিতি না, কাজেই জানিস না। কেউ খবর রাখে না।
নীলু লজ্জিত বোধ করল। সে সত্যিই কোনো খোঁজ নেয় নি। অথচ তার আজকের এই চাকরি বন্যাই জোগাড় করে দিয়েছে। কত উৎসাহে সে ছোটাছুটি করেছে। কত ঝামেলা করেছে।
নীলু, আমাকে হাজারখানেক টাকা দিতে পারবি?
পারব। কাল আসতে হবে। কাল আয়, আমি টাকা জোগাড় করে রাখব।
এখন তোর কাছে কত আছে?
পঞ্চাশ টাকার মতো আছে।
পঞ্চাশ টাকাই দে। কাল আবার আসব।
নীলু ব্যাগ খুলে টাকা বের করল। নিচু গলায় বলল, তোর আর সব খবর বল। কর্তা কেমন আছে?
জানি না কেমন আছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
বলছিস কী তুই!
ডিভোর্স হয়েছে তিন মাস হল।
নীলু ভয়ে-ভয়ে বলল, তোর বাচ্চাটা কার কাছে থাকে? তোর কাছে?
না।
ওনার সঙ্গে থাকে?
না, কারো সঙ্গেই থাকে না। চা খাওয়া তো নীলু চায়ের সাঙ্গে আর কিছু থাকলে তাও দিতে বল। খিদে লেগেছে।
ভাত খাবি?
না, ভাত খাব না।
বন্যা চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে নিতান্ত স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগল, বাচ্চাটা মরে গেল, বুঝলি? চার মাস হবার আগেই শেষ। ওর ধারণা হল, আমার জন্যেই মরেছে। আমি যত্ন নিই নি, অফিস নিয়ে থেকেছি। কী যে কু ৎসিত ঝগড়া! শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিলাম। তাতেও কিছু লাভ হল না। রোজ ঝগড়া। রোজ হৈচৈ, চিৎকার। এক দিন কী হয়েছে জানিস? লোকজনের সামনে হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল–
থাক, শুনতে চাই না। এখন কী করছিস তুই?
কিছু করছি না। বড়ো ভাইয়ের বাসায় থাকি আর ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া করি। ভাবী কী যে ঝগড়া করতে পারে, তুই কল্পনাও করতে পারবি না। ঝগড়ায় কোনো ডিগ্রি থাকলে ভাবী পি-এইচ.ডি. পেয়ে যেত।