দায়িত্ব বেড়েছে নীলুরও। সে একটি প্রমোশন পেয়েছে। অফিসে তার এখন ঘর আলাদা। ঘরের সামনে টুল পেতে এক জন বেয়ারা বসে থাকে। অফিসের নানান সমস্যা নিয়ে তাকে প্রতিদিনই মিটিং করতে হয়। এতসব ঝামেলা তার আগে ছিল না।
হোসেন সাহেবও ব্যস্ত। তিনি একটি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন, বইটির নাম সহজ হোমিওপ্যাথি যে-সব ডাক্তার গ্রামে চিকিৎসা করেন, বইটি লেখা হচ্ছে তাঁদের উদ্দেশ্য করে। কাজেই লিখতে হচ্ছে খুব সহজ ভাষায়। তিনি জোর দিচ্ছেন কেইস হিস্ট্রিতে। প্রতিটি রোগের জন্যে বেশ কয়েকটা কেইস হিস্ট্রি দিতে হচ্ছে। সে-সব খুঁজে বের করতে সময় নিচ্ছে। বেশ কিছু হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করছেন। তাদের এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই। এতে হোসেন সাহেবের উৎসাহে ভাঁটা পড়ছে না।
মনোয়ারা আগের তুলনায় খানিকটা শান্ত। কাজের একটি মেয়ে রাখা হয়েছে, নাম-নাজমা। তাঁর বেশির ভাগ সময়ই কাটছে নাজমার খুঁত ধরে। এই মেয়েটার কোনো কিছুই তাঁর পছন্দ নয়। নামাটাও অপছন্দ। তাঁর ধারণা, নাজমা হচ্ছে ভদ্রলোকের নাম। কাজের মেয়ের এ-রকম নাম থাকবে কেন? নাজমা মেয়েটির বয়স আঠার-উনিশ। এইটিও তাঁর পছন্দ নয়। এই বয়সের মেয়ে ঘরে রাখা মানে আগুন ঘরে রাখা। কোনো দিন কী-এক ঝামেলা বাধাবে, ছিছি পড়ে যাবে চারদিকে। মনোয়ারার বেশির ভাগ সময় এখন কাটছে কী করে মেয়েটিকে তাড়ানো যায়, এই বুদ্ধির সন্ধ্যানে। তেমন কোনো পথ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ নাজমা মেয়েটি খুবই কাজের। অতি অল্প সময়েই সে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছে। তবু মনোয়ারা চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। আজ ভোরবেলা তিনি রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, এই, তুই ঘর মুছলি কেন? সকালবেলা পানি দিয়ে ঘর ভাসিয়ে ফেলেছিস।
নাজমা সহজ স্বরে বলল, আপনেই তো কইছিলেন দাদী।
আমি কখন বললাম?
আপনে কইছিলেন সপ্তাহে একদিন ঘর
এ তোর ঘর ধোয়ার নমুনা? পানিতে চারদিক ছয়লাপ।
কই দাদী, পানি তো নাই। শীতের দিনে পানি শুকায় তাড়াতাড়ি।
আসলেই তাই, ইতোমধ্যেই চারদিক শুকনো খটখট করছে। মনোয়ারা কিছুতেই মেয়েটিকে জব্দ করতে পারেন না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। তীক্ষ্ণ নজর রাখেন, যদি বেচাল কিছু চোখে পড়ে।
এই, তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
ছাদে গেছিলাম দাদী।
তোকে না বললাম ছাদে যাবি না। ব্যাটাছেলে থাকে।
কাপড় শুকাতে গেছিলাম।
কাপড় শুকাতে সারা দিন লাগে?
গেলাম আর আসলাম দাদী, বেশিক্ষণ তো থাকি নাই।
আবার মুখে-মুখে কথা। তুই কি মনে করিস তোর মতলব আমি বুঝি না? আমি কচি খুকি?
বিশ্বাস করেন। দাদী, আমার কোনো মতলব নাই। তুই কাল সকালেই বিছানা-বালিশ নিয়ে বিদায় হবি। আমার পরিষ্কার কথা।
সত্যি যাইতে বলেন দাদী?
আমি কি তোর সাথে মশকরা করছ? ফাজিল কোথাকার! বড়ো বৌমা আসুক, তোকে আমি আজই বিদায় করব। পাখা উঠেছে!
নীলু এই মেয়েটির বিদায়ের কথা শুনতেই পারে না। নাজমা তাকে অনেকভাবে নিশ্চিন্ত করেছে, নীলু এই সুখ হারাতে রাজি নয়। উল্টো মেয়েটার কাছে তার নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। যে-সংসার তার দেখার কথা, তা দেখছে সংসারের বাইরের এক জন মানুষ। মমতা এবং ভালোবাসা নিয়েই দেখছে। এটা যেন ঠিক নয়, অন্যায়।
আগে সংসারের অনেকখানি দায়িত্ব শারমিন পালন করত। তার দায়িত্বও কমেছে। সে এখন পুরো সময় দিচ্ছে পড়াশোনায়।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিসটেন্টশিপের চিঠি এসেছে। ভিসার জন্য আই টুয়েন্টি তারা পাঠিয়েছে, এখনও এসে পৌঁছায় নি। এখন আর সময় নষ্ট করার উপায় নেই। শারমিন রাত-দিন পড়ে। রফিক দেখে, কিছু বলে না। তারা দুজন এমনভাবে জীবন যাপন করে, যেন কেউ কাউকে চেনে না।
এই পরিবারের সব কটি মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল শওকতের একটা চিঠি-কবির মাস্টারের কুলখানি। সবই যেন আসে। সে থাকার ব্যবস্থা গরিবি হালতে করে রেখেছে।
কারোরই যাওয়ার ইচ্ছা নেই। অনিচ্ছার বিষয়টাও তারা চেপে রাখতে চায়। এই ব্যাপারটা নীলুর মন খারাপ করে দিল। এ-রকম কেন হবে? যে-মানুষটি এ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্যে গাঢ় ভালবাসা পোষণ করেছেন, তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ করে এরা কেউ সামান্য ত্যাগ স্বীকার কেন করবে না?
এক দিন সে রফিককে কথায়-কথায় জিজ্ঞেস করাল, কবে যাচ্ছ রফিক?
রফিক খুব অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?
মামার কুলখানিতে যাবে না?
মামার কুলখানি তো দূরের কথা, আমার নিজের কুলখানি হলেও যেতে পারব না।
তোমার কি মনে হয় না, যাওয়া উচিত?
না। এসব লোকদেখানো ব্যাপার। মারা গেল ফুরিয়েগেল। আর কী?
তাই বুঝি।
হ্যাঁ, তাই। তা ছাড়া এসব কুলখানি হচ্ছে হিন্দুয়ানি ব্যাপার। হিন্দুরা যেমন মৃত্যুর পর শ্ৰাদ্ধ করে, ওদের দেখাদেখি আমরা কুরি কুলখানি।
ধর্মজ্ঞানও তোমার হয়েছে মনে হয়।
তুমি এমন করে তাকাচ্ছ কেন ভাবী? আমার শতেক ঝামেলা। আমি পারছিনা।
শফিকও যাবে না। সে ছুটির চেষ্টা করেছিল। টলম্যান ছুটি দেয় নি। বলেছে।–অসম্ভব। আগামী দু মাস কোনো ছুটি নেই। সামনের মাস থেকে শুক্রবারেও তোমাকে কাজ করতে হবে।
শফিক মনে হল এতে খুশিই হয়েছে। অন্তত তার না-যাওয়ার একটা কঠিন অজুহাত আছে। ঠিক হল, হোসেন সাহেব সোভােহানকে নিয়ে যাবেন। হোসেন সাহেব শেষ পর্যন্ত যেতে পারলেন না। ঢাকা থেকে গেল শুধু সোভােহান। বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে গেল।