কোনো অসুবিধা নেই। এই অবস্থায় আপনাকে নিয়ে রওনা হব না। গরুর গাড়িতে বিছানা করে দিচ্ছি, শুয়ে থাকুন। আমি যাব আর আসব।
নবীনগরের ডাক্তার সাহেবকেও পাওয়া গেল না। তিনি বিরামপুর কলে গিয়েছেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই। নাও ফিরতে পারেন। বিরামপুরের কাছেই তাঁর শ্বশুরবাড়ি। রাতটা হয়তো শ্বশুরবাড়িতেই কাটাবেন।
সোবাহান ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে ফিরে এসে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখল-গরুর গাড়ির চারপাশে অসংখ্য মানুষ।
চারদিক খবর রটে গিয়েছে, অসুস্থ কবির মাস্টার গ্রামে ফিরেছে। দলে দলে লোক আসছে। ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। বিশাল একদল মানুষ নিয়ে গরুর গাড়ি রওনা হল।
আশপাশের মানুষ জিজ্ঞেস করে, কে যায় গো?
কবির মাস্টার যায়।
কী হইছে মাস্টার সাবের?
শইল খুব খারাপ। উল্টাপাল্টা কথা কইতাছে।
কও কী! কী সর্বনাশের কথা।
খেতের কাজ ফেলে রেখে চাষীরা উঠে আসে রাস্তায়। তারা এক পলক দেখতে চায় মাস্টার সাহেবকে। দুটি কথা শুনতে চায়।
সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে। চলমান মানুষগুলির ছায়া ছোট হয়ে আসে। কবির মাস্টার চোখ মেলে এক বার জিজ্ঞেস করেন, আর কত দূর সোভাহান? আর যে কত দূর সোভাহান নিজেও জানে না। এই অঞ্চল তার অপরিচিত। তবু সে বলে, এসে পড়েছি। ঐ তো দেখা যাচ্ছে।
সুখী নীলগঞ্জ সাইনবোর্ড দেখা যায়? বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছি।
র মাস্টার টেনে টেনে হাসেন। সোভাহান কোনো সাইনবোর্ড দেখতে পায় না। শুধু দেখে, মানুষ আসছে পিলপিল করে। চিৎকার নেই। হৈচৈ নেই। নিঃশব্দ মানুষ। মাথা নিচু করে এরা হাঁটছে।
সোভাহান।
জ্বি মামা।
শুধু সাইনবোর্ডটাই আছে। নীলগঞ্জকে সুখী নীলগঞ্জ করতে পারলাম না। আফসোস রয়ে গেল।
এক জীবনে তো হয় না মামা। আপনি শুরু করেছেন, অন্যরা শেষ করবে। শুরু করাটাই কঠিন। শুরু তো হয়েছে।
ঠিক ঠিক। খুব ঠিক।
আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে মামা?
হচ্ছে। আবার আনন্দও হচ্ছে। কত লোক এসেছে, দেখলে?
জ্বি, দেখলাম।
কিছুই করতে পারি নি। এদের জন্যে। তবু এরা আসছে। বড়ো আনন্দ ल१छ 6নাठহানা।
আনন্দ হবারই কথা।
জীবনটা তাহলে একেবারে নষ্ট হয় নি। কী বল?
জ্বি-না। অসাধারণ জীবন আপনার!
পানি খাওয়াতে পার? বুক শুকিয়ে আসছে।
বটগাছের ছায়ার নিচে গরুর গাড়ি রাখা হল। চার-পাঁচ জন ছুটে গোল পানির খোঁজে। আশপাশের বাড়ির বৌ-ঝিরা সব বেরিয়ে আসছে। এদের মধ্যে অল্পবয়স্ক একটা মেয়ে খুব কাঁদছে। সে নীলগঞ্জের মেয়ে। এই গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের দিন খুব গণ্ডগোল হচ্ছিল। জামাইকে সাইকেল দেয়ার কথা, সেই সাইকেল দেওয়া হয়নি। বিয়ে ভেঙে বরযাত্রীর দল উঠে যাবে। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। খবর পেয়ে ছুটতে—ছুটতে এলেন কবির মাস্টার। থমথমে গলায় বললেন, সাইকেল আমি দেব। বিয়ে হোক।
কবির মাস্টারের কথাই যথেষ্ট। বিয়ে হয়ে গেল। তার পনের দিন পর নতুন সাইকেল নিয়ে কবির মাস্টার এসে উপস্থিত। তিনি সাইকেল নতুন জামাইয়ের হাতে দিয়েই আচমকা প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, হারামজাদা ছোটলোক। সাইকেলটা তোর কাছে বড়ো হল? তুই একটা মেয়েকে বিয়ের দিন লজ্জা দিলি? তোর এত বড়ো সাহস!
ছেলেটা ভালো ছিল। সাত দিন পর সাইকেল ফিরিয়ে দিয়ে গেল। লাজুক গলায় বলল, আপনার দেয়া চাই মাস্টার সাব, আর কিছু চাই না। আপনে খাস দিলে আমার জন্যে দোয়া করেন।
কবির মাস্টার গম্ভীর হয়ে বললেন, দোয়া লাগবে না। সৎ মানুষের জন্যে দোয়া লাগে না। দোয়া দরকার অসৎ মানুষের জন্যে। তোর বেঁটাকে আদর-যত্নে করিস। ভালো মেয়ে।
সেই মেয়েটাই এখন চিৎকার করে কাঁদছে। কয়েক জন বৃদ্ধা মহিলা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। কবির মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন, তুই এরকম করছিস কেন? সালাম করেছিস আমাকে? আদব-কায়দা কিছুই শিখিস নি। নীলগঞ্জের মেয়ে না। তুই? গ্রামের বদনাম। আয়, সালাম কর। তোর জামাই কই? ব্যাটাকে ধরে নিয়ে আয়।
নীলগঞ্জে ঢোকার ঠিক আগে আগে কবির মাস্টার মারা গেলেন। নিঃশব্দ মৃত্যু। কেউ কিছুই টের পেল না। সবাই ভাবল, বোধহয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। সোভাহান তাঁর হাত ধরে বসে ছিল, শুধু সে টের পেল। হাত নামিয়ে দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে এল। অসংখ্য লোকজন চারপাশে। সবাই নিঃশব্দে হাঁটছে। সেও হাঁটছে তাদের সঙ্গে। এই মানুষগুলিকে মৃত্যুর খবর দিতে তার মন চাচ্ছে না।
গরুর গাড়ি নীলগঞ্জের সীমানায় এসে এক মুহূহের জন্যে থমকে দাঁড়াল; নীলগঞ্জের সীমানায় বিশাল এক রেইনটি গাছ। সেই গাছে সাইনবোর্ড ঝলছে। সেখানে লেখা :
আপনারা সুখী নীলগঞ্জে প্রবেশ করছেন। স্বাগতম।
নীলগঞ্জের সমস্ত বৌ-বিরাজড়ো হয়েছে সেখানে। ছুটতে-ছুটিতে আসছে। শওকত। আজ সকালেই সে থানা-হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছে। নীলগঞ্জের চেয়ারম্যান তাকে একটা ডাকাতি মামলায় আসামী দিয়েছিল। ওসি সাহেব নিজ দায়িত্বে তাকে জামিন দিয়েছেন। শওকত চেঁচাতে-চেঁচাতে আসছে— কী হইল? আমার স্যারের কী হইল?
দুপুরবেলার শান্ত নিস্তব্ধ গ্রাম। করুণ সুরে ঘুঘু ডাকছে। ক্যাচ-ক্যাচ শব্দে এগিয়ে চলছে গরুর গাড়ি। সোভাহান দাঁড়িয়ে আছে রেইনটি গাছের কাছে। তার দৃষ্টি সাইনবোর্ডের দিকে :
আপনারা সুখী নীলগঞ্জে প্রবেশ করছেন। স্বাগতম।
সোভাহানের মনে হচ্ছে সুখী নীলগঞ্জ জায়গাটা বড়ো পবিত্র। এরকম একটা পবিত্র জায়গায় প্রবেশ করবার মতো যোগ্যতা তার নেই। তার উচিত। এই সীমানা থেকেই বিদেয় নেওয়া।
কবির মাস্টারের মৃত্যু
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, কবির মাস্টারের মৃত্যু এ বাড়ির কাউকে তেমন স্পর্শ করল না। রফিক তার নতুন অফিস, নতুন ব্যবসা নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত। ভোরবেলা বেরিয়ে যায় ফেরে। অনেক রাতে। শফিকেরও এই অবস্থা। তার দায়িত্ব দিন-দিন বাড়ছে। সালফিউরিক অ্যাসিড প্লান্টের কাজ এগুচ্ছে দ্রুতগতিতে। শফিকের বেশির ভাগ সময়ই চলে যাচ্ছে সেখানে। যখন বাসায় ফেরে, এমন ক্লান্ত থাকে যে ভাত খেয়ে বিছানায় যেতে-না-যেতেই ঘুমে চোখজড়িয়ে আসে।