পাঠাচ্ছি।
রফিক খেতে বসেছে। কবির মামা ডেকেছেন শুনে মুখ বাঁকা করে বলল, ওল্ড ম্যান আমার কাছে কী চায়? এখন যেতে পারব না।
নীলু বলল, চট করে না বলে ফেল কেন? এক জন অসুস্থ মানুষ ডাকছে, তুমি যাবে না?
শুধু ভ্যাজারভ্যাজার করবে।
যদি করে, হাসিমুখে শুনবে সেই ভ্যাজরভ্যাজর।
তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন ভাবী? আমি তো জাস্টি কথার কথা হিসেবে বলেছি। তুমি খুব ভালো করে জান আমি মুখে না বললেও কবির মামাকে দেখতে ঠিকই যাব। খ। তাঁর সব ফালতু কথা শুনব। যে কদিন উনি হাসপাতালে ছিলেন, আমি কি রোজ তাঁকে দেখতে যাই নি?
নীলু লজ্জা পেয়ে গেল। রফিক ভাত শেষ না-করেই উঠে পড়েছে। নীলু বলল, তুমি কি আমার উপর রাগ করলে রফিক?
না, তা করি নি। আমি তো মেয়েমানুষ না যে কথায়-কথায় রাগ করব। আর যদি করিও তাতে কার কী যায় আসে?
রফিক কবির মামার ঘরে ঢুকল।
মামা জেগে আছ?
বস রফিক।
বসব না। যা শোনবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনব। বল কী বলবো?
তুই আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবি?
কোন জায়গায়?
আগে বল নিয়ে যাবি কিনা?
নিয়ে যাব।
বারাসাতে যাব। ঐখানে আমাকে নিয়ে যা।
সেটা আবার কোথায়?
চব্বিশ পরগণা জেলা।
ইণ্ডিয়া?
হ্যাঁ। বেনাপোল বর্ডার দিয়ে…।
তুমি কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে নাকি মামা!
জন্মস্থান দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি আর বাঁচব না।
তুমি একা কেন, আমরা কেউ বাঁচব না। জন্মস্থান দেখলে হবেটা কী? ঐখানে গিয়ে মরতে চাও?
তিনি জবাব দিলেন না। রফিক খাটে বসল। নরম স্বরে বলল, জন্মস্থানে মরতে যেমন কষ্ট, বিদেশে মারতেও ঠিক সে-রকম কষ্ট। মরার কষ্ট সব জায়গায় সমান।
তুই তাহলে নিতে পারবি না?
না মামা, পারব না। পাসপোর্ট-ফাসপোর্টের অনেক ঝামেলা। আমার মনে হয় মরতে চাইলে তুমি তোমার সুখী নীলগঞ্জেই মর। সেটাই ভালো হবে।
তিনি হেসে ফেললেন। রফিকও হাসল। হাসতে-হাসতেই বলল, তুমি আবার আমার উপর রাগ করলে না তো?
না, তোর কোনো কথায় আমি রাগ করি না।
খুব ফালতু কথা বলি, এই জন্যে?
তাও না। তোর কথাবার্তা ঠিকই আছে। তোর কথাবার্তা আমার পছন্দ। যা শুয়ে পড়া।
বারাসাতে যেতে চাচ্ছি। কেন?
মনটা হঠাৎ টানছে। হাসপাতালে শুয়ে—শুয়ে অনেক ভেবেছি। বারাসাতে শৈশব কেটেছে। একটা বিরাট পুকুর ছিল, নাম হল গিয়ে ভূতের পুকুর। ছোটবেলায় ভূত দেখার জন্যে এর পাড়ে বসে থাকতাম।
দেখেছ?
না, দেখিনি।
মামা আমার কথা শোন-এখন যদি যাও, তোমার খুবই খারাপ লাগবে। দেখবে, সব বদলে গেছে। ভূতের পুকুর হয়তো ভরাট করে দালান তুলেছে। এরচে শৈশবের স্মৃতিটাই থাকুক।
কবীর মামা শুয়ে পড়লেন। রফিক মশারি গুঁজে দিতে-দিতে বলল, এর পরেও যদি তোমার যেতে ইচ্ছে করে, তাহলে কী আর করা, নিয়ে যাব। কী, ইচ্ছে করে?
তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, হ্যাঁ করে।
রফিক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মাস তিনেক তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে মুম্ আদি একটা কাজ শুরু করেছি। একটু গুছিয়ে নিই।
কী কাজ?
ব্যাবসা। মতিঝিলে রুম নিয়েছি। কাউকে কিছু বলিনি। বুধবারে বলব। সবাইকে অফিস দেখিয়ে আনব। তুমি থাকছতো বুধবার পর্যন্ত?
থাকব। দেখে যাই তোর কাণ্ডকারখানা।
মামা, এখন যাই?
আচ্ছা যা। বাতি নিভিয়ে যা।
শারমিন জেগে আছে। আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে। মেয়েদের চুল বাঁধার দৃশ্যটি বেশ সুন্দর। দেখতে ভালো লাগে। রফিক খানিকক্ষণ দেখল। ছন্দবদ্ধ ব্যাপার। চিরুনি উঠছে-নামছে। ওঠা-নমা হচ্ছে নির্দিষ্ট তালে। রফিক সিগারেট ধরাল। শারমিন বলল, দয়া করে সিগারেটটা বাইরে গিয়ে খাও।
কেন?
ঘরে কুৎসিত গন্ধ হয়, আমার ভালো লাগে না।
গন্ধ তো আগেও হত, তখন তো কিছু বল নি।
তখন বলি নি বলে কখনও বলতে পারব না। এমন তো কোনো কথা নেই। এখন বলছি।
রফিক সিগারেট ফেলে দিল। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে শারমিন চুল বাঁধা শেষ করে উঠল। দরজা বন্ধ করে বাতি নেভাল। মশারি ফেলে হালকা গলায় বলল, তুমি কি ঘুমুবে, না। আরো কিছুক্ষণ জেগে বসে থাকবে?
ঘুমুব।
বিছানায় উঠতে-উঠতে শারমিন বলল, তোমার মতিঝিলের অফিস স্টার্ট হচ্ছে কবে? রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, অফিসের খবর তুমি কোথায় পেলে?
কেন, এটা কি গোপন কিছু?
না, গোপন কিছু না। কাউকে তো বলি নি। তুমি জানলে কী ভাবে? কে বলল?
আজবাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বাবা বললেন।
তিনি জানলেন কোত্থেকে?
তিনি জানবেন না কেন? সব তো তাঁরই করা। বেকার জামাই বোধহয় সহ্য হচ্ছিল না। দূর থেকে কলকাঠি নাড়লেন।
রফিক স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এই সম্ভাবনা তার মাথায় আসে নি। রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। কেন সব এমন ঘড়ির কাঁটার মতো সহজে হচ্ছিল, এটা বোঝা গেল।
শারমিন বলল, দেখে মনে হচ্ছে অধিক শোকে পাথর। শ্বশুরের সাহায্য নিতে চাও না?
রফিক সে প্রশ্নের জবাব দিল না। বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে সিগারেট টানবে। মাথা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবে। ঘুমুতে যাবে অনেক রাতে। যখন যাবে, তখন দেখবে শারমিন পরম তৃপ্তিতে ঘুমুচ্ছে। তার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসবে না। নানান আজে-বাজেচিন্তা তার মাথায় ভিড় করবে। একেক দিন একেক জিনিস নিয়ে সে ভাবে। আজ ভাববে। শারমিন হঠাৎ করে বাবার কাছে কেন গেল? পিতা-কন্যার মিলন তাহলে হয়েছে। কীভাবে হল কে জানে! শারমিন নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, খুব ভুল করেছি। বাবা। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আর কোনোদিন তোমার অবাধ্য হব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব। এবারকার মতো আমাকে ক্ষমা করি।