অনেক রাতে নীলু টুনিকে বাথরুম করবার জন্যে দরজা খুলল!
কী ব্যাপার রফিক, জেগে আছ যে?
ঘুম আসছেনা ভাবী।
গ্রামার কাছে কে যেন এসেছিল। কী এক স্যানেজার। বাবার সঙ্গে গল্প
করছিল।
রফিক কোনো রকম উৎসাহ দেখাল না। ক্লান্ত গলায় বলল, শারমিন তোমাকে কি কিছু বলেছে ভাবী?
কোন প্রসঙ্গে?
বাইরে যাবার ব্যাপারে।
না তো! কোথায় যাচ্ছে?
রফিক জবাব না দিয়ে উঠে পড়ল। বাতি নেভাতে-নেভাতে বলল সকালে বলব।
যা ভাবা গিয়েছিল তাই। ঘুম আসছেনা। পাশেই শারমিন। গায়ের সঙ্গে গা লেগে আছে, তবুও দু জনের মধ্যে অসীম দূরত্ব। এই দূরত্বকে কমানোর কোনোই কি উপায় নেই? রফিক ছোট্ট, নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুজল। কবির মামার কথাটা ভাবীকে বলা হয় নি। তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। ঝামেলার উপর ঝামেলা।
রফিক একটু লজ্জিত বোধ করল। নিজের সমস্যাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্য সব এখন ঝামেলা।
নীলুও জেগে আছে। শফিক বাড়িতে না থাকলে তার এ-রকম হয়। সারাক্ষণ একটা চাপা ভয় বুকের উপর বসে থাকে। মনে হয় এ বাড়িতে যেন কোনো পুরুষমানুষ নেই। বড়ো কোনো বিপদ-আপদ হলে কে সামলাবে? হয়তো আগুন লেগে গেল, চোর এল বাড়িতে, কিংবা ডাকাত পড়ল। তখন কী হবে? নীলু মাঝে মাঝে ভাবে সব মেয়েরাই কি তার মতো ভাবে? এই নির্ভরশীলতার কারণটা কী?
টুনি শক্ত করে তার গলা চেপে ধরে আছে। ফাঁসের মতো লাগছে। বিশ্ৰী অভ্যাস মেয়েটার। ঘুমের সময় হাতের কাছে যা পাবে তাই শক্ত করে ধরবে। নীলু ক্ষীণ স্বরে বলল, টুনি ঘুমাচ্ছিস?
টুনি জবাব দিল না।
হাতটা একটু আলগা কর মা। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
টুনি আরো শক্ত করে গলা চেপে ধরল। ঘুমের ঘোরেই বলল, কমলা খাব না। বললাম তো খাব না।
কবির মামা বাড়ি ফিরে এসেছেন
কবির মামা বাড়ি ফিরে এসেছেন। বাড়ি মানে নিজের বাড়ি নয়–নীলুদের ভাড়াটে বাসা। এ বাসায় কত অসংখ্য বার তিনি এসেছেন, এমনও হয়েছে টানা এক মাস কেটে গেছে।–নাড়ার নাম নেই। কিন্তু এ-বার এসে কিছুটা অদ্ভুত আচরণ করছেন। যেন তিনি অপরিচিত একটা জায়গায় এসেছেন-লোকজন ভালো চেনা নেই। শারমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, মা, বাথরুমটা কোন দিকে? বাথরুম কোন দিকে তাঁর না-জানার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্নের ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে তিনি জানেন না।
রাতে খাবার টেবিলে বসলেন, কিন্তু কিছু মুখে দিলেন না। মনোয়ারা বললেন, ভাইজান, আপনাকে দুটা রুটি বানিয়ে দেবে? তিনি বললেন–জ্বি-না। আপনাদের কষ্ট দিতে চাই না।
মনোয়ারার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ভাইজান তাঁর সঙ্গে আপনি-আপনি করছেন কেন? তিনি তাকালেন নীলুর দিকে। নীলু বলল, মামা, আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে?
না। আমি ভালো।
মামা আসুন আপনাকে শুইয়ে দি। দুধ গরম করে দিচ্ছি। দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ুন।
কবির মামা নিঃশব্দে উঠে পড়লেন। তাঁর খুব খারাপ লাগছে। তিনি এ-রকম করছেন কেন? তাঁর গায়ে জ্বর নেই। এ-রকম করার তো কথা নয়।
মাখন-লাগানো দু স্নাইস রুটি আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে নীলু কবির মামার ঘরে ঢুকল।
মৃদু স্বরে ডাকল, মামা।
আয় বেটি। আয়।
আপনার জন্যে রুটি আর দুধ এনেছি।
রেখে দাও মা। খিদে পেলে খাব।
না, আপনাকে এখনই খেতে হবে। আপনাকে খাইয়ে তারপর আমি যাব।
কবির মামা একটু হাসলেন, তারপর নেহায়েত যেন নীলুকে খুশি করবার জন্যেই পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দুধে ড়ুবিয়ে মুখে দিতে লাগলেন।
মাখন দেয়া রুটি মামা, দুধে ডোবাচ্ছেন কেন?
নরম হয়, খেতে সুবিধা।
আপনার খেতে ইচ্ছা না-হলে খাবেন না মামা। শুধু দুধটা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলুন।
তিনি বাধ্য ছেলের মতো দুধ খেয়ে ফেললেন।
পান খাবেন মামা? একটু পান এনে দিই। মুখের মিষ্টি-মিষ্টি ভাবটা যাবে।
তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন পান তো আমি খাই না। ঠিক আছে, তোমার যখন ইচ্ছা, দাও।
পান এনে নীলু দেখল মামা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধহয়। সে চাপা গলায় বলল, মামা ঘুমিয়ে পড়েছেন? না, জেগে আছি। দাও, পান দাও। আর একটু বস আমার পাশে। নীলু বসল। তিনিও উঠে বসলেন। নরম গলায় বললেন, আচ্ছা মা, তোমার বিয়েতে কি আমি কিছু দিয়েছিলাম?
নীলু বিস্মিত হয়ে বলল, হঠাৎ এই কথা কেন মামা? না, মানে, হঠাৎ মনে হল। এ জীবনে তোমার কাছ থেকে শুধু সেবাই নিয়েছি। কিছু ফেরত দেয়া হয় নি।
আপনার ভালোবাসা যা পেয়েছি, সেটা বুঝি কিছু না মামা? তা ছাড়া আপনার মনের শান্তির জন্যেই বলছি, আপনি বিয়েতে খুব দামী একটা শাড়ি দিয়েছিলেন। নীল রঙের একটা কাতান। চার শ টাকা দাম ছিল শাড়িটার। তখন চার শ টাকায় একটা গয়না হয়ে যেত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ মামা। আমার বিয়ের শাড়ির দাম ছিল তিন শ টাকা। আমার বড়ো বোন বললেন, বিয়ের শাড়িটা থাক, এইটা দিয়েই বৌ সাজিয়ে দিই।
না মামা। বিয়েতে নাকি লাল শাড়ি পরতে হয়, তাই সবাই মিলে আমাকে লালটা পরাল। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা করছিল নীলটা পরতে।
কবির মামা হাসতে লাগলেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে এই গল্পে তিনি খুব আনন্দ পাচ্ছেন। তাঁর চোখেও পানি এসে যাচ্ছে। যদিও চোখে পানি আসার মতো গল্প এটা না।
মামা।
বল মা।
তখন তো আপনার নীলগঞ্জ ছিল না, টাকাপিয়াস যা পেতেন। আমাদের পেছনেই খরচ করে ফেলতেন। শুয়ে পড়ুন মামা।
রফিক কি বাসায় আছে মা?
জ্বি, আছে। এই কিছুক্ষণ আগে এসেছে।
ওকে কি একটু আমার কাছে পাঠাবো?